ঝুলে আছে জাল নোট সংক্রান্ত সাড়ে ৫ হাজার মামলা

পাচার ঠেকাতে স্থল সীমান্তে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর স্থাপনের সিদ্ধান্ত

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১৯

গাফফার খান চৌধুরী

বছরের পর বছর ঝুলে আছে জাল নোট সংক্রান্ত সাড়ে পাঁচ হাজার মামলার ভাগ্য। মামলাগুলোর মধ্যে জালনোটের সঙ্গে অর্থ পাচারের অভিযোগে দায়েরকৃত সাড়ে তিনশ' মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। জাল নোটবিরোধী অভিযানে পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছে চক্রের ছয় হাজারের বেশি সদস্য। যাদের অধিকাংশই জামিনে মুক্ত। জালনোট কারবারে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখার চার কর্মকর্তাসহ দশজনকে চাকরিচু্যত করা হয়েছে। তারপরও থেমে নেই জাল নোটের কারবার। জালমুদ্রা পাচার ও চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তের চিহ্নিত পয়েন্টগুলোয় জালনোট শনাক্তকারী দুই শতাধিক আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। যে কারণে সীমান্ত পথে জালনোটের পাচার কমে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, ২৬ নভেম্বর প্রায় আট কোটি ভারতীয় জাল রুপিসহ রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার ফাতেমা আক্তার অপি ও আবু তালেবকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা আন্তর্জাতিক জাল নোট পাচারকারী চক্রের সদস্য বলে স্বীকার করেছে। তাদের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতে থাকা আন্তর্জাতিক একাধিক জাল নোট কারবারি চক্রের যোগাযোগ আছে। তারা পাকিস্তান থেকে সুলতান ও শফি নামে দুই পাকিস্তানির কাছ থেকে ভারতীয় জালরুপি সংগ্রহ করত। সেগুলো প্রথমে শ্রীলঙ্কা নিত। সেখান থেকে বাংলাদেশে আনত। জব্দ হওয়া জাল নোট ভারতে পাচারের পরিকল্পনা ছিল। দুই দেশে কতগুলো জাল নোট পাচারকারী চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।

পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আরও জানান, ২০১০ সালে তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবার জাল নোটের কারবারে

জড়িয়ে পড়ে। অন্তত ১৫ বছর ধরে তারা এ কারবারে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ভারত ছাড়াও অন্য দেশের জালনোট তৈরি বা বেচাকেনার সঙ্গে তারা জড়িত কিনা, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জালনোট ব্যবসায় জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা ও পার্শ্ববর্তী দেশের বেশকিছু চোরকারবারি। তারা জালনোট দিয়ে জিনিসপত্র বেচাকেনা করে অর্থ পাচার করছে। জঙ্গি সংগঠনগুলোও দলে অর্থের জোগান বাড়াতে জালনোটের ব্যবসা করে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মো. মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সম্প্রতি ভারতীয় জালরুপি চক্রের অন্যতম প্রধানহোতা বশির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশেই তিনি জালরুপি তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিলেন। কারখানা স্থাপনের টাকার জোগান এসেছে বাইরে থেকে। জালরুপির কারখানা স্থাপনের অর্থের জোগানদাতার সন্ধান চলছে। জালরুপি তৈরি করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিক্রি করত। তাদের সঙ্গে ভারতীয় জালরুপি কারবারীদের যোগাযোগ আছে।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, বশির উদ্দিন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত ৮টি দেশে ভালো চাকরি করেছে। দেশে ফিরেই শুধু জালরুপি তৈরি ও সরবরাহের কাজ কেন শুরু করেছে, তা জানতে তদন্ত চলছে। নেপথ্যে কে বা কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দুর্বল করতেই কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে জালনোট উৎপাদন ও বাজারজাত করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে ডিবি পুলিশের অভিযানে প্রায় সাড়ে ৫শ' দেশি-বিদেশি জালনোট কারবারী গ্রেপ্তার হয়েছে। যার মধ্যে সাড়ে ৪শ' বিদেশি। এদের অধিকাংশই আফ্রিকান। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি বিপুল অঙ্কের জালনোট এবং তা তৈরির সরঞ্জাম।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার যায়যায়দিনকে বলেন, আরও দ্রম্নততার সঙ্গে জালনোটের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তারদের বিচার হওয়া দরকার। তাদের সাজা আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় ধীরগতির কারণে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থেকেই তারা আবার জালনোট তৈরি ও বেচাকেনার চেষ্টা করে।

র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে জানান,র্ যাব সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই হালনাগাদ দেশি-বিদেশি প্রায় আড়াইহাজার জালনোট কারবারী গ্রেপ্তার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে অন্তত দশ কোটি জাল ভারতীয় রুপির নোট।

সিআইডির সূত্রটি বলছে, জালনোটের মাধ্যমে চোরাচালান ব্যবসা এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। এজন্য ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এলে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে ১৪ নাম্বার চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জালনোট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জালনোট কারবারীদের ধরতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও কম্বিং অপারেশন চলছে। এসংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত আদান-প্রদান হচ্ছে।

এসব বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মুখপাত্র লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, জালনোট পাচার ও চোরাচালানসহ সীমান্তের যেকোনো ধরনের অপরাধ কমাতে আমরা সর্বদা তৎপর। এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানসহ যৌথ টহল ব্যবস্থাও বহাল আছে। চোরাচালানপ্রবণ অনেক পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। ওইসব পয়েন্টে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। যার মধ্যে জালনোট শনাক্তকারী দুই শতাধিক মেটাল ডিটেক্টরও রয়েছে। জালনোট শনাক্তের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। চোরাচালানপ্রবণ পয়েন্টগুলোয় চব্বিশ ঘণ্টাই যৌথ টহল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জালনোট সংক্রান্ত স্বাক্ষরিত চুক্তির সূত্র ধরেই ভারত সরকার ছাড়াও বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাস, দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান ও অভিযান অব্যাহত আছে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, জালনোটের আগ্রাসন কমাতে পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জালনোটসহ পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে গ্রেপ্তারের পর সরকারের তরফ থেকেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশটির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দুর্বল করে দিতেই পরিকল্পিতভাবে জালনোট ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পরামর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, জালনোট সংক্রান্ত ২৭ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। সরাসরি জালনোটসহ গ্রেপ্তারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর গ্রেপ্তারকারী সংস্থাই সাধারণত তদন্ত করে। আর জালনোট সংক্রান্ত মামলার সঙ্গে অর্থ পাচারের বিষয় জড়িত থাকলে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব মামলা মনিটরিং করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত সংস্থা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সেসব মামলার তদন্ত করে।

বাংলাদেশের ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে হালনাগাদ জালনোট সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলাই ২০১৫ সালের আগে দায়েরকৃত। ২০১৫ সালের পর গত ৬ বছরে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩শ'। জালনোটের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখার চার কর্মকর্তাসহ দশজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ থেকে জালমুদ্রা আসা ঠেকাতে বিমান বন্দরগুলোয়ও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।