গাড়ির চাকায় পিষ্ট দুর্জয়ের স্বপ্ন

ঘাতক বাসের চালক ও হেলপার গ্রেপ্তার

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

ম গাফফার খান চৌধুরী
চা বিক্রেতা পিতামাতার অভাব ঘোচানোর স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নিল না। পড়াশোনা করে আর মানুষের মতো মানুষ হওয়া হলো না রামপুরায় বাস চাপায় নিহত ছাত্র মাইনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয়ের। তার আগেই বেপরোয়া গতির বাসের চাকায় স্বপ্ন পিষ্ট হলো তার। ভালো চাকরি করে একমাত্র বড়ভাই চালক মনিরকে একটি পুরনো প্রাইভেটকারও কিনে দেয়ার স্বপ্ন ছিল দুর্জয়ের। সবই এখন স্বপ্ন। লাশের সঙ্গে দুর্জয়ের স্বপ্নকেও গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হলো। এদিকে দুর্জয় নিহতের ঘটনায় বাসটির চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছাত্র নিহতের ঘটনায় রামপুরা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। একটির বাদী দুর্জয়ের মা। অপরটির বাদী পুলিশ। নিহত ছাত্র দুর্জয়ের মামা মোহাম্মদ রায়হানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নিহতের পরিবারের নানা বিষয় সম্পর্কে। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, দুর্জয়দের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে অনেক আগেই তারা গ্রাম ছেড়েছে। বাসা বাঁধে পশ্চিম রামপুরার তিতাস সড়কের ১৮০/খ নাম্বার বাড়িতে। সেখানেই অনেক বছর ধরে ভাড়ায় বসবাস করছে তারা। দুর্জয়ের পিতা আব্দুর রহমান (৫৫)। মা রাশেদা বেগম (৪৫)। তিতাস রোডে পিতামাতা মিলে রাস্তার পাশে ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান দিয়েছে। সেই দোকানের আয় দিয়েই সংসার চলত। এক মেয়ে দুই ছেলের সংসার। সবার বড় বোন ঝুমা। অভাবের কারণে পড়ালেখা করাতে পারেনি। বছর পাঁচেক আগে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার সংসারে দুই সন্তান আছে। এরপর ভাই মনির। পয়সার অভাবে লেখাপড়া না হওয়ায় অভাবের সংসারে হাল ধরার চেষ্টা করে। ড্রাইভিং শিখে একজনের প্রাইভেট কার চালায়। দোকান আর মনিরের চাকরি থেকে আসা টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলত। সবার ছোট দুর্জয়। অভাবকে জয় করে সংসারে সুদিন ফিরিয়ে আনবে, সেই আশা থেকেই তার নাম রাখা হয়েছিল দুর্জয়। যে সবকিছু জয় করবে। জয় করতেও চেয়েছিল। কিন্তু হলো না। সোমবার রাত ১১টা। দুর্জয় রামপুরার ডিআইটি রোডের রাস্তা পার হচ্ছিল। এ সময় বাড্ডা থেকে মালিবাগের দিকে দুটি বাস পালস্নাপালিস্ন করে যাচ্ছিল। দুর্জয় রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি বাসের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। পাশ দিয়ে যাওয়া অনাবিল পরিবহণের বেপরোয়া গতির একটি বাস তাকে রাস্তায় পিষে চলে যায়। মুহূর্তেই ঘটনাস্থলেই দুর্জয়ের মৃতু্য হয়। দুর্জয় চলতি বছরের ২৩ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। সে রামপুরার একরামুন্নেছা স্কুলের ছাত্র ছিল। মামা মোহাম্মদ রায়হান বলছিলেন, দুর্জয় আমাকে বলত পরিবারের কেউ যেহেতু অভাবের কারণে পড়ালেখা করতে পারল না, তাই সে পড়াশোনা করে পিতামাতার অভাব ঘোচাবে। পিতামাতাকে আর রাস্তার পাশে বসে চা বিক্রি করতে দেবে না। আর ভাইকে একটি পুরনো গাড়ি কিনে দেবে। সেটি উবারে চালিয়ে তাদের ভালোভাবেই সংসার চলে যাবে। কিন্তু সবই এখন স্বপ্ন। দুর্জয়ের সব জয় করার স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নিল না। লাশের সঙ্গে দুর্জয়ের স্বপ্নকেও দাফন করা হলো ব্রাক্ষণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। বলেই তিনি কাঁদতে লাগলেন। মঙ্গলবার দুপুরের পর ময়নাতদন্ত শেষে দুর্জয়ের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ কর্তৃপক্ষ। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানান, বাস চাপায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুর্জয়ের মৃতু্য হয়। লাশটি গ্রহণ করেন নিহতের বড়ভাই মনির। পরে লাশটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানেই মঙ্গলবার বিকালে দাফন সম্পন্ন হয় বলে জানিয়েছেন নিহতের মামা মোহাম্মদ রায়হান। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রোজিনা আক্তার যায়যায়দিনকে বলেন, বাস চাপায় ছাত্র নিহতের পর পুরোএলাকা উত্তাল হয়ে পড়ে। খবরটি ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একরামুন্নেছা স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যায়। এরপরই শুরু হয় ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ। ঘটনার পর থেকে রাত দেড়টা নাগাদ ১২টি যাত্রীবাহী বাস ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা ও শিক্ষার্থীরা। এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্র নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই শত শত উত্তেজিত জনতা রামপুরার ডিআইডি সড়কে অবস্থান নেয়। তারা বাস ভাঙচুর ও তাতে অগ্নিসংযোগ করে। অনেক বাস চালক ও হেলপার বাস রেখেই পালিয়ে যায়। তবে অনাবিল পরিবহণের যে বাসটির চাপায় দুর্জয়ের মৃতু্য হয়েছে, সেটি আর পালাতে পারেনি। জনতা বাসটিকে ঘেরাও করে তাতে ভাঙচুর করে। এক পর্যায়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হেলপার পালিয়ে যায়। চালক পালিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভিং সিটের পাশে থাকা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল জনতা। লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে জনতার সন্দেহ হয়। তারা চালককে গণপিটুনি দেয়। রাত দেড়টার দিকে পুলিশ প্রায় মৃত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। ওসি জানান, ড্রাইভারের নাম সোহেল বলে জানা গেছে। বয়স আনুমানিক ৩২ বছর। নাম বলার পর থেকেই সে অজ্ঞান। রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ হেফাজতে তাকে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গাড়িটি জব্দ করে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। গাড়িটির বৈধ কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তবে চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। এদিকের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে জানান, মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর রামপুরায় অনাবিল পরিবহণের বাস চাপায় শিক্ষার্থী মাইনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয় নিহতের ঘটনায় বাসটির হেলপার চান মিয়াকে (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোরে রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তিনি অন্য বাসে করে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ যায়যায়দিনকে জানান, চালক সুস্থ হওয়ার পর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।