রাজনীতিতে কদর কমেছে ত্যাগী কর্মীদের

বড় কর্মসূচিতে দুঃসময়ের কর্মীদের বদলে এখন ভাড়াটে লোকজনের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০৫

সাখাওয়াত হোসেন

রাজনীতিতে কর্মীদের কদর কমে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথে বিরোধী দল বিএনপির ত্যাগী কর্মীরা এখন চরম অবহেলিত। সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির কর্মীদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মাঠে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এবং বিরোধী দলের কঠোর কোনো কর্মসূচি না থাকায় নেতাদের কাছে তারা গুরুত্ব হারিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দলে ভেড়া নতুনরা কর্মী সেজে বিভিন্ন শো-ডাউনে অংশ নিচ্ছে। বড় কর্মসূচিতে দুঃসময়ের কর্মীদের বদলে এখন ভাড়াটে লোকজনের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এক সময়ের সক্রিয় কর্মীরাও এখন নেতাদের কাছে অনেকটা অপাংক্তেয়। হরতাল-অবরোধে পিকেটিং এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে শক্তির মহড়া না থাকায় নেতারা তাদের এড়িয়ে চলছেন। এ ছাড়া মামলার ভারে অনেক নেতা নিজে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় কর্মীরা তাদের কাছে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কথায় চাপা ক্ষোভ ও হতাশার সুর মিলেছে। নেতারাও অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ বিষয়টি স্বীকার করছেন। ক্ষমতাসীন দলের ত্যাগী নেতাদের একাংশ এজন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করে নিজেদের অবমূল্যায়িত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, রাজনীতির গতানুগতিক কৌশলের পটপরিবর্তন হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আগে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচিতে নাশকতামূলক কর্মকান্ড প্রতিহত করতে দলীয় কর্মীদের ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সরকার এখন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই তা সামাল দিচ্ছে। কখনো কখনো সংকট সমাধানে এগিয়ে আসছে প্রশাসন। ফলে রাজনীতিতে কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা এখন আগের মতো নেই। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, মূলত নির্বাচনে জয় লাভের টার্গেট করে রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। আর এজন্যই বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বছর কর্মীদের চাঙা রাখা হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে রাজনীতির মাঠে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সরকারি দল নির্ভার। তাই ত্যাগী কর্মীদের বিষয়ে নেতাদের আগ্রহ কমেছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মীদের অবমূল্যায়িত করে দলের অবস্থা কি পরিমাণ দুর্বল হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়। তার অভিযোগ, শীর্ষ নেতারা টাকার বিনিময়ে বহিরাগত ও ভুঁইফোড় নেতাদের ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। ফলে দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা তাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেননি। দলের যেসব ত্যাগী নেতা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে নামেন, তার পক্ষে কাজ করেছেন। এতে দল মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে মুন্সীগঞ্জের ১৪টি ইউপির মধ্যে মাত্র ৫টিতে দল মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হলেও ৮টিতে তারা বিদ্রোহী প্রাথীর কাছে হেরে গেছেন। একটি ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। শুধু মুন্সীগঞ্জেই নয়, সারাদেশে দল মনোনীত বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ অনেকটা একই বলে মনে করেন দায়িত্বশীল এই নেতা। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের একজন নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু কর্মীদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়েনি; শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদেরও বড় গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। এসব দুর্বলতার বিষয় তারা দলীয় হাইকমান্ডের নজরে আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ওই নেতার দাবি, এখন যারা কর্মী সেজে বিভিন্ন শো-ডাউনে অংশ নিচ্ছেন, আগামীতে বিরোধী দল কঠোর কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। এছাড়া দলের দুঃসময়ে ভাড়াটে লোকজন কোনো কাজে আসবে না। তখন দলকে ত্যাগী কর্মীদেরই খুঁজতে হবে। অথচ দলে অবমূল্যায়িত হয়ে তাদের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে রাজনীতি থেকে সরে গেছে। এদিকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক মহড়ায় বহিরাগত ও ভাড়াটে কর্মীদের দাপিয়ে বেড়ানোর ঘটনা অনেকটা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। গত ১২ নভেম্বর যুবলীগের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শো-ডাউনে পাঠাও-সহ বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং মোটর সাইকেল চালককে অংশ নিতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, কর্মী বিচ্ছিন্ন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কিছু ভুঁইফোড় নেতা রাইড শেয়ারিংয়ের মোটর সাইকেল চালকদের ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়ায় নিয়ে মহড়া দিয়েছেন। যা ওইসব রাইড শেয়ারাররা নিজেরাও স্বীকার করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি থানার স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা জানান, অবহেলিত কর্মীরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যে কোনো কর্মসূচিতে দলে-বলে যোগ দেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট কাটাতে তিনি নিজ এলাকার কয়েকটি রাস্তার ফুটপাতে হকার বসিয়েছেন। তাদেরকে এ সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে দলীয় যে কোনো শো-ডাউনে তাদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। ওই নেতার ভাষ্য, এ ছাড়া তার কাছে কোনো বিকল্প নেই। কর্মী সংকটের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ঢাকার বেশিরভাগ নেতাই এখন এ কাজ করছেন বলে জানান তিনি। এদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কর্মীরা গত বেশ কয়েক বছর ধরে আরও বেশি অবহেলিত। তাদের অভিযোগ, দলের যে কোনো কর্মসূচিতে তারা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিচ্ছেন। অথচ তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো মামলা-মোকাদ্দমা হলে দলীয় নেতারা কোনো সহযোগিতা করছেন না। এমনকি নূ্যনতম খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন না। রাজধানীর সবুজবাগের থানা পর্যায়ের একজন যুবদল কর্মী জানান, গত ১২ বছরে তার বিরুদ্ধে ৮টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি মামলাতে তিনি প্রায় ৮ মাস জেল খেটেছেন। এ সময় একজন নেতাও তাকে দেখতে কারাগারে যাননি। এমনকি বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কাছে খবর পাঠালেও তারা তার পরিবারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। সক্রিয় ওই কর্মীর অভিযোগ, নেতারা যখন যে কর্মসূচিতে যেভাবে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন তিনি সেভাবেই তা পালন করেছেন। তিনি কখনো তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেননি। তবে ৮ মাস জেল খাটার পর তিনি বুঝেছেন, নিজের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রাজনীতিতে অংশ নিতে হবে। ওই কর্মীর দাবি, তার মতোই দলের হাজার হাজার কর্মী নেতাদের কাছে উপেক্ষিত। তারা শুধু প্রয়োজন হলেই তাদের খোঁজ করেন। এ কারণে অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। এ অবস্থায় ভাড়াটে লোকজনই দলের কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, রাজনীতি বর্তমানে ভিন্ন ফরম্যাটে চলে গেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তৈরি করা 'সিস্টেম'ই তদেরকে সব উদ্দেশ্য হাসিল করতে সহায়তা করছে। এই অপরাধ বিশ্লেষক আরও বলেন, রাজনীতিতে মূলত আদর্শিক কর্মীর কদর কমেছে। পক্ষান্তরে দখলবাজ, চাঁদাবাজ ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে পারদর্শী কর্মীর চাহিদা বেড়েছে।