এসব নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে আমানত কমেছে ৩৮০ কোটি টাকা

আস্থাহীনতায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১২

আহমেদ তোফায়েল

অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) ওপর আমানতকারীরা আস্থা হারানোয় এ খাত তারল্য সংকটে পড়েছে। এর ওপর করোনা মহামারি- এ সংকট আরও উসকে দিয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আস্থাহীন অনেক গ্রাহক এ খাত থেকে আমানত তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করছে। এতে তারল্যে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এনবিএফআই'র আমানতের পরিমাণ ৩৮০ কোটি টাকা কমেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, আস্থার সংকটে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এনবিএফআইগুলো থেকে ব্যাংকগুলো তাদের তহবিল এবং গ্রাহকরা তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন। এ কারণে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এসব প্রতিষ্ঠানে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। বছরের জুনে এসে সে আমানতের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ২৬৪ কোটি ২৯ লাখ টাকায়। ২০১৮ সালে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা। আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁঁইয়া বলেন, 'গত কয়েক মাসে এনবিএফআই থেকে ব্যাংকগুলো তহবিল তুলে নেওয়ার জন্য এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।' তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যখন করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ঋণের চাহিদা কমে যায়। তাই নতুন তহবিলের জন্য এনবিএফআইয়ের চাহিদাও কমে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৪ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন এনবিএফআই থেকে ব্যাংকগুলোকে তাদের আমানত প্রত্যাহার না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো সে অনুরোধ রাখেনি। ফলে তাদের তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে ৩৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১১টির অবস্থা খুবই দুর্বল। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এটা ফিরিয়ে আনাটাই হবে এখন বড় ব্যাপার। একটা খারাপ হলেই যে সব খারাপ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাজারে যারা আছে সবারই যৌথ ভূমিকা দরকার। এদিকে, মেয়াদপূর্তির পরও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটালে এফডিআর রেখে টাকা ফেরত পাচ্ছে না যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেরি স্টোপস ক্লিনিক সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাত কোটি টাকা আটকে আছে। বিএটি বাংলাদেশের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ১০৯ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এই তহবিলের আটটি এফডিআরের মেয়াদপূর্তি হয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে। নানা উপায়ে চেষ্টা করেও আমানত ফেরত নিতে পারছে না তারা। সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিতে ৩০০ কোটি টাকা রেখে আটকে গেছে আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। বারবার তাগাদার পরও জমানো টাকা তুলতে পারছে না। আর্থিক খাতের নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের একসময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা। ২০১৪ সালে দখলের পর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। এর বাইরে আরও কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সময়মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে যাওয়ায় আর্থিক খাতে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে করে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদ অফার করার পরও সাধারণ আমানতকারীদের মতো করপোরেটগুলোও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাইছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পদ্মা, আইসিবি ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, বেসিকসহ কয়েকটি ব্যাংক সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবস্থার অবনতি বেশ আগে থেকে হলেও এত খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর। এর কিছু দিনের মধ্যে চার প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারের টাকা তুলে নিয়ে পালানোর বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ আমানতকারীর মতো ব্যাংক এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে টাকা তোলার চাপ তৈরি হয়। তখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তা জানাজানি হয়ে যায়। অধিকাংশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে তহবিল জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট তহবিলের ৬০ শতাংশের মতো আসে ব্যাংক থেকে। পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন প্রক্রিয়ার দুই বছর পার হলেও এখনো কোনো আমানতকারী টাকা ফেরত পাননি। প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা আমানতের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত রয়েছে সাড়ে সাতশ' কোটি টাকা। আইসিবিতে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা আছে অগ্রণী ব্যাংকের। আসল টাকা ফেরত না পেয়ে বাধ্য হয়ে বছরের পর বছর পুনর্বিনিয়োগ করছে ব্যাংকটি। আইসিবিতে এ তহবিল রাখা শুরু ২০১৬ সালের মে মাসে। শুধু যে আইসিবির কাছে অন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের টাকা আটকে আছে, তা নয়। আইসিবিও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আর ফেরত পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১৪৫ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ১১৮ কোটি ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ে ৩৩ কোটি টাকা জমা রেখে তুলতে পারছে না। অর্থ আদায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আইসিবি। বিষয়টি জানার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর সম্প্রতি সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে আপাতত মামলা না করার অনুরোধ জানান। এর আগে একাধিক ব্যাংক টাকা তুলতে না পেরে মামলার উদ্যোগ নেয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকার্স সভায় মামলা না করে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ আদায়ের জন্য বলেছে। ফারইস্ট ফাইন্যান্সে অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমানে ৬০ কোটি টাকা রয়েছে। এর মধ্যে ছয় মাস মেয়াদে ১০ কোটি টাকা রাখা হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ ২০২০ মালের মে মাসের পর আর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিও টাকা ফেরত দেয়নি। একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৫৬ কোটি ১৯ লাখ, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৫৬ কোটি ১৩ লাখ, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৫০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিংয়ে ৩৭ কোটি টাকা করে, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ৩৩ কোটি এবং বিআইএফসিতে রাখা ২০ কোটি টাকা ফেরত নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে ফেরত পাচ্ছে না পলস্নী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পিডিবিএফের ২৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার তিনটি এফডিআরের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। প্রিমিয়ার লিজিংয়ে তিন কোটি ৬১ লাখ টাকার মেয়াদও পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। এর বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে জমানো টাকার বিপরীতে সুদ পেলেও মূল টাকা তুলতে পারছে না তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাকা ফেরত পাওয়া আমানতকারীর অধিকার। কোনো প্রতিষ্ঠান সময়মতো অর্থ ফেরত দিতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ এলে তা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়।