পরীক্ষামূলকভাবে ১২ ডিসেম্বর থেকে চলবে ডিয়াবাড়ী-আগারগাঁও

রাজধানীর গণপরিবহণের চেহারা পাল্টে দেবে মেট্রোরেল

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০৫

আব্দুলস্নাহ রায়হান

রাজধানীর যানজট নিরসনে স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রম্নতগতিতে। রাতদিন সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন প্রকল্পের হাজারো নির্মাণ শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। চলছে নানা রকম কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। করোনা মহামারির কারণে কাজের আশাতীত অগ্রগতি না হওয়ায় উত্তরার ডিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শেষ করে আগামী বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেল চালু করতে চাইছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। মেট্রোরেল চালু হলে তা ঢাকা শহরের গণপরিবহণের চেহারা পাল্টে দেবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলকভাবে আগামী ১২ ডিসেম্বর ডিয়াবাড়ী ডিপো থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত গিয়ে আবার ডিপোতে ফিরে আসবে মেট্রোরেল। এর জন্য ইতোমধ্যে রেললাইন, বৈদু্যতিক সঞ্চালন লাইন ও স্টেশনের যাবতীয় কাজ শেষ হয়েছে। নিয়মিত চলবে এ রুটের টেস্ট ড্রাইভ। বর্তমানে উত্তরা থেকে পলস্নবী অংশে নিয়মিত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হচ্ছে। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি-৬ এর কাজের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ হয়েছে প্রায় ৯৫ শতাংশ। ডিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রতি সাড়ে তিন মিনিটে চলবে একটি ট্রেন। এটা হলো গড় ফ্রিকোয়েন্সি। অফিস সময়ে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। অন্য সময়ে কম থাকবে। বসে ও দাঁড়িয়ে প্রতি ট্রিপে দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে মেট্রোরেল প্রকল্পটি ডিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তা কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। মেট্রোরেলের এ লাইনে ১৬টি স্টেশন থাকবে। প্রাথমিকভাবে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন চালু হবে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকার ৯টি স্টেশনে মেট্রোরেল উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে কোভিডের ভয়াবহতা বেড়ে গেলে কাজ অনেক দিন বন্ধ ছিল। এজন্য আগামী বছরের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কোভিডের কারণে বাধা সত্ত্বেও মেট্রোরেলের কাজ দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলেছে। জাপান-বাংলাদেশ তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করবে আগামী বছর। ওই সময়ে মেট্রোরেল চালু হবে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বছর ৯টি স্টেশনে মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হলেও ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাকি ৭টি স্টেশনে গড়াবে মেট্রোরেলের চাকা। মেট্রোরেলে প্রতিটি সেটে থাকবে চারটি যাত্রীবাহী কোচ। এর দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন থাকবে। ডিএমটিসিএল কর্তৃৃপক্ষ জানায়, প্রতি স্কয়ার মিটারে ৮ জনের হিসাবে ব্যস্ততম সময়ে প্রায় ১ হাজার ৭০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। জাপানে তৈরি স্টেইনলেস স্টিলের কোচগুলোর ভেতরে লম্বালম্বি দুই পাশে রয়েছে বসার আসন। প্রতিটি কোচে দু'টি হুইল চেয়ার রাখারও জায়গা থাকবে। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, মেট্রোরেলে কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি জনবলের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৬১ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কেউ মারা যাননি। মোট প্রকল্পের যে ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে, এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৯৫ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্ত কাজ হয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল সিস্টেম ও রোলিং স্টক ও ডিপোর ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশ। সম্প্রতি জাপান থেকে আসা এই বৈদু্যতিক ট্রেনের ছয়টি কোচের একটি সেট চালিয়ে লাইন পরীক্ষা করা হয়। এ সময় গণমাধ্যমের কয়েকশ' কর্মী উপস্থিত ছিলেন। মেট্রোরেলে প্রতিটি সেটে থাকবে চারটি যাত্রীবাহী কোচ, দুই দিকে দু'টি ইঞ্জিন। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের এমআরটি-৬ লাইনের জন্য ২৪ সেট ট্রেন তৈরি করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি। এ ট্রেন ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে। ট্রেনের বেশিরভাগ উপাদান যেমন কারবডি, বগি, প্রপালশন সিস্টেম, ট্রেনের তথ্য ব্যবস্থা, পাওয়ার সাপস্নাই সিস্টেম, ডোর অপারেটর, হুইল ও এক্সেল জাপানে তৈরি। ব্রেক সিস্টেম জার্মানি ও এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট আনা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা খুবই উচ্চ। যাত্রীদের নিরাপত্তায় ট্রেনের ভেতরে ও বাইরে সিসিটিভির ব্যবস্থা থাকবে। সিগন্যালিং ব্যবস্থা জাপানের মতোই অত্যাধুনিক। সূত্র জানায়, রাস্তার মাঝ বরাবর ওপর দিয়ে উত্তরা থেকে মিরপুর-ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যেতে মেট্রোরেলের সময় লাগবে ৪০ মিনিটেরও কম। ট্রেনগুলো চলবে ডিসি ১৫০০ ভোল্ট বিদু্যতে। এই প্রথম দেশে বৈদু্যতিক ট্রেন চালু হতে যাচ্ছে। মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন হবে- উত্তরা, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পলস্নবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০ নম্বর, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম এবং মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকায়। ট্রেন পস্ন্যাটফর্মের সমতলে হওয়ায় যাত্রীদের ওঠানামা সহজ হবে। দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্য প্রতিটি কোচে রয়েছে প্রচুর হাতল। কোন স্টেশনে ট্রেন থামল তা জানা যাবে ডিসপেস্নতে। প্রতিদিনই সাত সেট ট্রেনের ট্রায়াল রান হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে ১০টি ট্রেন সেট ঢাকায় পৌঁছবে। জানুয়ারিতে উত্তরার ডিয়াবাড়ীতে অবস্থিত প্রদর্শনী কেন্দ্রটি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সেখানে সাধারণ মানুষ শিখতে পারবে কীভাবে টিকিট মেশিনে দিয়ে মেট্রোরেলে চড়তে হবে। প্রথমদিকে ছাত্রছাত্রীদের জন্য এ ট্রায়াল চালু করা হবে। এরপর সাধারণ মানুষকেও তা জানানোর সুযোগ দেওয়া হবে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরে উত্তরার ডিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে। এর আগে একাধিক টেস্ট রয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য পারফরম্যান্স টেস্ট, ইন্টিগ্রিটি টেস্ট শেষ করে ৫ মাস পর্যন্ত যাত্রী ছাড়া চালানো হবে ট্রেন। সব পরীক্ষা সফল হলে যাত্রীসহ ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ঢাকার মানুষও অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় বহুদিন ধরে ভোগান্তি সয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের ভাড়া এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। ভাড়া সবার সামর্থ্যের মধ্যে থাকবে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, মেট্রোরেল থেকে সরকার কোনো লাভ করবে না। এটা পরিচালনার জন্য ব্যয় যা হয় ভাড়ার টাকায় সেই ব্যয় মেটানোর চেষ্টা করা হবে মাত্র। ডিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সম্পূর্ণ লাইনের বৈদু্যতিক সঞ্চালন লাইন ও স্টেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ হয়েছে উলেস্নখ করে এন এম সিদ্দিক জানান, বিজয়ের মাসে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের পারফরমেন্স টেস্ট ড্রাইভ চলবে। ১২ ডিসেম্বর ডিয়াবাড়ী থেকে প্রথম মেট্রোরেল আগারগাঁও আসবে। এরপর থেকে নিয়মিতই পরীক্ষামূলক যাত্রা চালু থাকবে এ রুটে। মেট্রোরেল চালু হলে বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দূরদর্শিতার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার একান্ত চেষ্টায় আজ মেট্রোরেল মাথার ওপর দিয়ে গড়াচ্ছে। মাত্র এক বছর পরই মানুষ মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন। ফলে ঢাকার যানজট অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।