রাজধানীতে টানা বৃষ্টি

পরিবহণ সংকট, যানজট আর জলজটে ভোগান্তি চরমে

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৩৪

ম আব্দুলস্নাহ রায়হান

ঘূর্ণিঝড় 'জাওয়াদ'র প্রভাবে গত দু'দিন ধরে ঢাকাসহ সারাদেশে টানা বৃষ্টিতে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে বৃষ্টির কারণে রাজধানীতে অফিসগামী, বিভিন্ন স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাওয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের দুর্ভোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে রাজধানীতে গণপরিবহণেরও সংকট দেখা দেয়। অন্যদিনের তুলনায় সোমবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় বাসের সংখ্যা কম দেখা গেছে। গাড়ি না পেয়ে ভোগান্তি বেড়েছে নগরবাসীর। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, শাহবাগ, মালিবাগ, মগবাজার, মহাখালী এলাকায় সকালের দিকে সড়কে সীমিত সংখ্যক যানবাহন দেখা গেছে। বেলা বাড়ার পর কিছু যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও অনেকেই চড়তে পারেননি হুড়োহুড়ির কারণে। এ ছাড়া টানা বৃষ্টির কারণে রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বাসাবো, মুগদা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। পুরান ঢাকার কয়েকটি গলি ও সড়কে বৃষ্টির পানি জমেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থলে যেতে শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষকে নর্দমার ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়ে যেতে হয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দা জানান, একটু বৃষ্টিতেই ড্রেনের ময়লা পানি রাস্তায় জমে যায়। ঢাকার আনন্দবাজার, তেজগাঁও, আরামবাগ, মিরপুরের বিভিন্ন সড়কে পানি জমে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এসব এলাকায় দুপুরের পর থেকে পথে নামা মানুষের ভোগান্তি তীব্রতর হয়। সড়কে বাস না পেয়ে অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটেছেন। অনেকে আবার সিএনজি অটোরিকশা রিকশায় চড়েছেন কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায়। পথের যাত্রীদের অভিযোগ, কয়েকগুণ বেশি ভাড়া মিটিয়েই যাত্রী তুলছে সিএনজি চালকরা। রিকশা চালকরাও ৪-৫ মিনিটের দূরত্বে যেতে ভাড়া হেঁকেছেন ৫০-৭০ টাকা। সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে একই এলাকায় নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে। এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে পারে। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রাখা হয়েছে। রাজধানীতে অনেকেই মাঝারি ধরনের বৃষ্টির কারণে জরুরি কারণ ছাড়া বাসা থেকে তেমন বের হয়নি। অনেকেই জাওয়াদের প্রভাবে ভারী বর্ষণের খবরে আগের দিনই অতি জরুরি জিনিসপত্র আগে থেকেই কিনে রেখেছেন। তবে সকালের দিকে কর্মজীবীরা কর্মস্থলে যেতে দুর্ভোগে পড়েছেন। বিকালের পর রাস্তায় গণপরিবহণ না পেয়ে অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় পৌঁছান। আর যারা যানবাহনে চড়েছেন তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টির মধ্যে সড়কের যানজটে বসে থাকতে হয়েছে। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এরাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকালের দিকে ছাতা মাথায় ও রেইনকোট পরে গন্তব্যে ছুটছেন সারি সারি মানুষ। হঠাৎ বৃষ্টিতে ছাতা না থাকায় অনেকেই মাথায় পলিথিন মুড়িয়েও সড়কে নেমেছেন। বিভিন্ন রুটের লেগুনাগুলোয় ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। সকাল ৮টায় বৃষ্টিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে গণপরিবহণের তীব্র সংকট দেখা দেয়। মিরপুর ০১, মিরপুর ১০ ও পলস্নবী এলাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে অফিসগামী ও সাধারণ মানুষকে গণপরিবহণ, রিকশা ও অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। যাত্রাবাড়ীতে বাসের জন্য মানুষ দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। একটি বাস এলেই হুড়োহুড়ি করে অনেকে উঠতে পারলেও বয়স্ক ও নারী যাত্রীরা ভিড় ঠেলে বাসে চড়তে পারেননি। এ কারণে তাদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা কর্মরত উৎসব আহমেদ বলেন, গুলশানে অফিসে যাব। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সড়কে বাস নেই। যে দুই-একটা বাস আসছে সেগুলোয় এত হুড়োহুড়ি যে, ওঠা যাচ্ছে না। ভিক্টোরিয়া পার্ক বাস স্টেশনে বাসের সংখ্যা কম দেখা গেছে। যাত্রীদের ছাতা মাথায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যে দু-একটা বাস আসছে সেগুলো অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হয়ে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, লক্ষ্ণীবাজার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা বৃষ্টির কারণে কয়েকটি এলাকার অলি-গলিতে জলাবদ্ধতাসহ কাদার সৃষ্টি হয়েছে। পথচারীদের বৃষ্টিতে ও পানিতে ভিজে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। মিরপুরের ওয়াসা রোডসহ বিভিন্ন সড়কে দীর্ঘসময় জলজট দেখা যায়। মুগদা, খিলগাঁও, বাসাবোর নিম্নাঞ্চলে সড়কের জমা পানি অনেকের বাড়িতে ঢুকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে রাজধানীল গুলিস্তান, শাহবাগ, বাংলা মোটরে যানজট ছিল বেশি। এ ছাড়া মহাখালীর বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধীরগতিতে গাড়ি চলাচল করেছে। এজন্য মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে মহাখালী পর্যন্ত গাড়ির জট লেগেই ছিল দিনভর। সাইন্সল্যাব মোড়ের যানজট শাহবাগ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। কাজের তাগিদে দুপুর ১টায় বাইরে বেরিয়ে অফিসগামী যাত্রী আলী হোসেন সাইনবোর্ডে সিএনজি না পেয়ে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এ সময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে রাস্তায় গণপরিবহণের সংকট দেখা দিয়েছে। সিএনজি চালকরা ভাড়া বেশি চাইছেন তাই বাসের জন্য অপেক্ষা করছি দীর্ঘসময় ধরে। কিভাবে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাব এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। চানখাঁরপুল মোড়ে মহাখালী যাওয়ার জন্য সিএনজি খুঁজছিলেন ওয়াসায় চাকরি করা মিজান মাতবর। তিনি বলেন, সিএনজিগুলো চানখাঁরপুল থেকে মহাখালীর ভাড়া চাইছে ৫০০-৬০০ টাকা! অথচ এই পথে মিটারে গেলে সর্বোচ্চ ভাড়া উঠবে ১৬০-১৭০ টাকা। একসময় তিনি কোনো যানবাহন না পেয়ে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মগবাজারের উদ্দেশ্যে রিকশায় ওঠেন। শাহবাগ মোড়ে রিকশাচালক সেলিম বলেন, যানজটে বৃষ্টির মধ্যে ভিজেই রিকশা চালাইতেছি। পাবলিক বেশি ভাড়া দিতে চান না। অনেক রাস্তাই ভাঙাচোড়া। রিকশা চালাতে অনেক কষ্ট হয়। পাবলিক বোঝেন না। ১০-২০ টাকা বেশি চাইলেই রাগ করেন। এদিকে মৌমিতা, ঠিকানা, রজনীগন্ধা পরিবহণের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টির কারণে অনেক চালকই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হননি। মৌমিতা পরিবহণের কন্ডাক্টর নিয়াজ মোর্শেদ জানান, তাদের প্রায় ৬০টি বাস সোমবার রাস্তায় নামেনি। আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে জানা যায়, বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সোমবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী (২২ থেকে ৪৩ মিলিমিটার) থেকে ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) বর্ষণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগ ছাড়া সব বিভাগেই বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে যশোরে, ৭৬ মিলিমিটার। ঢাকায় ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার এমন আবহাওয়া থাকবে না। ঠান্ডা অনুভব হবে। সাগরের গভীর নিম্নচাপটির কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার রয়েছে। দমকা ও ঝড়ো হাওয়া বেড়ে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সব সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেতের আওতায় রাখা হয়েছে।