অর্থ সংকটে আটকা ৫১০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ

উদ্বোধন করা হয়েছে ৫০টি হ ২০২০ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল হ একসঙ্গে ৫৬০ মসজিদ নির্মাণের ঘটনা বিশ্বে বিরল হ বছর বছর প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৩৪

ম আমানুর রহমান

দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ কাজ-২০২০ সালে শেষ করার কথা থাকলেও ২০২১ সালের শেষ মুহূর্তে এসেও তা শেষ হয়নি। গত জুনে মাত্র ৫০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হলেও কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ কমপেস্নক্সের রূপ পায়নি। শুধু মসজিদ অংশটিই চালু হয়েছে। ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ প্রকল্পের অন্য অনুষঙ্গগুলো চালু করা যায়নি অর্থ সংকট ও বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় গত জুনের পর থেকে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। পাওনা বকেয়া না দেওয়ায় ঠিকাদারদের মধ্যেও কাজে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। গত ১০ জুন প্রথম ধাপে যে ৫০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেন, প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মসজিদগুলো ঢাকার সাভার, ফরিদপুরে মধুখালী, সালথায়, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া ও কুলিয়ারচর, মানিকগঞ্জের শিবালয়, রাজবাড়ী সদর, শরীয়তপুর সদর ও গোসাইরহাট, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, শেরপুর ও কাহালু, নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা, সিরাজগঞ্জ জেলা সদর ও উপজেলা সদর, পাবনার চাটমোহর, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও পবা, দিনাজপুরের খানসামা ও বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও উপজেলা সদর, রংপুর জেলা সদর, মিঠাপুকুর, উপজেলা সদর, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওর হরিপুর, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও তারাকান্দা, চট্টগ্রাম জেলা সদর, লোহাগড়া, মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, জামালপুরের ইসলামপুর ও উপজেলা সদর উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও বিজয়নগরে, ভোলা সদর, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, কুমিলস্নার দাউদকান্দি, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, কুষ্টিয়া সদর, খুলনার জেলা সদর, চাঁদপুরের কচুয়া, ঝালকাঠির রাজাপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদরে অবস্থিত। প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক \হ(ডিপিডি) শফিকুর রহমান তালুকদার যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে সব জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এতে ৫০টি মসজিদ নির্মাণ শেষ হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। শফিক তালুকদার জানান, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আজ (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিতব্য সভায় প্রকল্পটির ডিপিপি উপস্থাপনের কথা রয়েছে। নতুন ডিপিপির অনুমোদন পাওয়া গেলে প্রকল্পের জন্য মন্ত্রণালয়ে অর্থ ছাড়ের আবেদন করা হবে। ডিপিপি'র অনুমোদন না হলে অথবা একনেকে উপস্থাপন না হলে, প্রকল্পের কাজ নতুন করে চালু করা অসম্ভব হবে। এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, তারও অনেক টাকা পাওনা রয়েছেন ঠিকাদাররা। চলতি বছরের বাজেটে প্রকল্পের জন্য ২শ' কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ছাড় হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। একনেক সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত ডিপিপিতে মডেল মসজিদ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৮৩৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মধ্যে সব কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত জুনে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) সূত্র জানায়, মূল অনুমোদিত প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৯ হাজার ৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। পরে অনুমোদিত প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এবার (একনেকের বৈঠকের জন্য প্রস্তাবিত) ২য় সংশোধিত মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। নানা কারণে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিছু খাতের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এটি হয়েছে। যেমন- অফিসারদের বেতন, বিদু্যৎ, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, নিবন্ধন ফি, পেট্রোল, লুব্রিক্যান্ট, গ্যাস ও জ্বালানি, অন্যান্য মনোহারি, মোটরযান মেরামত ও সংরক্ষণ, অফিস সরঞ্জাম, ভবন নির্মাণে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া আপ্যায়ন ব্যয়, চুক্তিভিত্তিক যানবাহন ব্যবহার, ব্যাংক চার্জ, সাকুল্য বেতন, কুরিয়ার, যাতায়াত ব্যয়, আউটসোর্সিং, শ্রমিক মজুরি, নিয়োগ পরীক্ষা, মুদ্রণ ও বাঁধাই, অন্যান্য মনোহারি (গণপূর্ত), ডিজাইন ও ড্রইং (গণপূর্ত), আসবাবপত্র মেরামত ও সংরক্ষণ, কম্পিউটার মেরামত ও সংরক্ষণ কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অফিস সরঞ্জামাদি মেরামত ও সংরক্ষণ, অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংরক্ষণ, অভ্যন্তরীণ শোভাবর্ধন কাজ অন্তর্ভুক্ত করায় মূলত ব্যয় ও সময় বাড়ছে। এদিকে, বিএনপি'র নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলের শেষদিকে দেশব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় এবং তাদের অপতৎপরতা রোধের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সারাদেশের সব জেলা-উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করার প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়। মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং মসজিদকে জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়। প্রথমে এ পরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়নে সৌদি সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়। প্রথমে আশ্বস্ত করা হলেও এক পর্যায়ে থেকে সরে যায় সৌদি সরকার। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব তহবিল থেকে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। একসঙ্গে এতগুলো মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের ঘটনা বিশ্বে বিরল বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ইসলামের শুরু থেকে অদ্যাবধি একসঙ্গে এত (৫৬০টি) মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র নির্মাণের নজির দ্বিতীয়টি নেই। জানা গেছে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপেস্নক্সে নারী ও পুরুষদের পৃথক ওজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামিক বই বিক্রয় কেন্দ্র, পবিত্র কোরআন হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ, অটিজম কেন্দ্র, গণশিক্ষা কেন্দ্র, ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র থাকবে। এ ছাড়া ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা এবং গাড়ি পার্কিং সুবিধা রাখা হয়েছে। মডেল মসজিদগুলোয় দ্বীনি দাওয়া কার্যক্রম ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস, যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি রোধে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ৫৬০টি মডেল মসজিদে সারাদেশে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন মসজিদগুলোয় একসঙ্গে ১২শ' মুসলিস্ন নামাজ আদায় করতে পারবেন। উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোয় একসঙ্গে ৯শ' মুসলিস্নর নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। লাইব্রেরি সুবিধার আওতায় প্রতিদিন ৩৪ হাজার পাঠক একসঙ্গে কোরআন ও ইসলামিক বই পড়তে পারবেন। ইসলামিক বিষয়ে গবেষণার সুযোগ থাকবে ৬ হাজার ৮০০ জনের। ৫৬ হাজার মুসলিস্ন সবসময় দোয়া, মোনাজাতসহ তসবিহ পাঠ করতে পারবেন। মসজিদগুলো থেকে প্রতি বছর ১৪ হাজার কোরআনে হাফেজ তৈরির ব্যবস্থা থাকবে। আরও থাকবে ইসলামিক নানা বিষয়সহ প্রতিবছর ১ লাখ ৬৮ হাজার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ২ হাজার ২৪০ জন দেশি-বিদেশি অতিথির আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে প্রকল্পের আওতায়। কেন্দ্রগুলোয় পবিত্র হজ পালনের জন্য ডিজিটাল নিবন্ধনের ব্যবস্থা থাকবে। ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে ৪ তলা, উপজেলার জন্য ৩ তলা এবং উপকূলীয় এলাকায় ৪ তলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। 'এ' ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এই মসজিদগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৩৬০ দশমিক ০৯ বর্গমিটার। 'বি' ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে ৪৭৫টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ১ হাজার ৬৮০ দশমিক ১৪ বর্গমিটার। 'সি' ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৫২ দশমিক ১২ বর্গমিটার। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নিচতলা ফাঁকা থাকবে। একেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে ব্যয় ধরা হয়েছে, জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। উপজেলা পর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, প্রতিনিয়তই নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে। ফলে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চাইতে প্রকল্প সমাপ্তির পর ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. নজিবর রহমান জানান, মডেল মসজিদগুলো শুধু নামাজ পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এখানে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা সুযোগ থাকবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। তিনি আরও জানান, এটাই হচ্ছে বিশ্বে প্রথম কোনো সরকারের একই সময়ে একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক মসজিদ নির্মাণের ঘটনা। যা বিশ্বে বিরল।