লাশ সিঁড়িতে রেখে ফুটবল ম্যাচ দেখে উলস্নসিত খুনিরা!

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:২১

ম সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আববারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার পর খুনিরা তার নিথর দেহ দোতলা ও নিচতলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে নিয়ে রাখেন। এরপর তারা নিজেদের রুমে ফিরে টেলিভিশনে লা লিগার ফুটবল ম্যাচ দেখেন। খেলার উত্তেজনাকর মুহূর্তে তারা উচ্চস্বরে উলস্নাসও প্রকাশ করেন। নৃশংস এই হত্যা মামলার তদন্তে নেমে গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি চাঞ্চল্যকর এ তথ্য পায়। এ থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চিত হন, খুনিরা ঠান্ডা মাথায়ই এই খুনের ঘটনা ঘটায়। আদালতে দেওয়া চার্জশিটে এ তথ্য উলেস্নখ করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, পেটানোর সময় দুর্ঘটনাবশত স্পর্শকাতর কোনো অঙ্গে আঘাত লেগে আবরারের মৃতু্য হয়নি। বরং সারা শরীরে বেধড়ক পেটানোর কারণে রক্তক্ষরণ ও ব্যথার কারণেই মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন। আদালতে জমা দেওয়া ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, আবরারের হাত, পায়ে ও পিঠে আঘাতের দাগ ছিল। এই আঘাতের কারণেই তার মৃতু্য হয়েছে। আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে, ভোঁতা কোনো জিনিস যেমন- বাঁশ বা স্টাম্প দিয়ে আঘাত করা হয়। তবে তার মাথায় কোনো আঘাত ছিল না। কপালে ছোট একটি কাটা চিহ্ন ছিল। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি নৃশংস হত্যাকান্ড; কোনো দুর্ঘটনা নয়। অভিজ্ঞ আইনজীবীরা জানান, পেটানোর সময় দুর্ঘটনাবশত আবরার মারা গেলে আসামিদের সাজা কিছুটা কম হতো। কিন্তু যেহেতু তারা ঠান্ডা মাথায় সংঘবদ্ধভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, এ কারণে আদালত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে। আবরার হত্যা মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বুয়েটের শেরে বাংলা হলের বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থীকে এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের একজন জানান, পেটানোর একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতারা আবরারের হলের সহপাঠীদের ডেকে আনেন এবং তাদের দিয়ে নিথর দেহটি দোতলা ও নিচতলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে নিয়ে রাখেন। এরপর তারা বাইরে রাতের খাবার খেতে যান। পরে তারা যখন নিশ্চিত হন, আবরার বেঁচে নেই, তখন সিঁড়ি থেকে লাশ নিয়ে রাখা হয় হলের ক্যান্টিনে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, আবরারকে বেধড়ক পেটানোর পর তাকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে গেলেও হয়ত তাকে বাঁচানো যেত। তবে তারা এর সামান্য চেষ্টাও করেননি। বরং আবরারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে তারা এটি তার 'ভান' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাকে উচ্চমাত্রার ব্যথার ওষুধ খাইয়ে নিজেদের দায় সারতে চেয়েছে। পরে আবরার মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়লে খুনিরা নিজেদের রক্ষার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এদিকে আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে বুয়েটের দুই শিক্ষকের নিষ্ঠুর ভূমিকার বিষয়টি উলেস্নখ করা হয় বলে জানা গেছে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনায় ফাঁস হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আবরার রক্তাক্ত নিথর দেহ পাশে রেখে শেরে বাংলা হলের প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান এবং ছাত্রকল্যাণের পরিচালক মিজানুর রহমান নির্লিপ্ত ছিলেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তারা খুনিদের সঙ্গে হলগেটে আলাপচারিতায় মগ্ন। তাদের মধ্যেও আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে খুনিরাও সে কথা স্বীকার করেন। গোয়েন্দা রিমান্ডে খুনিরা জানান, শিবির সন্দেহে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আবরারকে থেমে থেমে ৫ ঘণ্টা অমানুসিক নির্যাতন চালানো হয়। বুয়েট ছাত্রলীগের আইন-বিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহার শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে রাত ৮টার পর থেকেই শুরু হয় নির্যাতনের পালা। মূলত তিন দফায় পেটানোর একপর্যায়ে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন আবরার। এই হত্যাকান্ডে ২৪-২৫ জন অংশ নেয়। যারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। রিমান্ডে খুনিরা আরও জানায়, প্রথম দফায় মারধরের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। তার সঙ্গে মারধর শুরু করেন বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ও উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। পরে যোগ দেন অনিক, জিওন, মনির এবং মোজাহিদুলসহ অন্যরা। প্রথম দফায় মারধর চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। এরপর রাতের খাবার খাওয়ানো হয় আবরারকে। খাওয়ানো হয় ব্যথানাশক ট্যাবলেট ও মলম দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফা মারধর শুরুর সময় অনিক ছিলেন সবচেয়ে মারমুখী। আবরার এ সময় বারবার বমি করছিলেন। একপর্যায়ে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় মুন্নার কক্ষে। সেখানে আবরারের শরীরের ওপর অনিক ক্রিকেট স্ট্যাম্প ভাঙেন। পরে আরেকটি স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। তৃতীয় দফার মারধর শুরু হয় মুন্নার কক্ষে। তখন মধ্যরাত। নির্মম পিটুনিতে আবরার লুটিয়ে পড়েন। এরপর নিথর দেহ টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন ঘাতকরা। মাঝ সিঁড়িতে যেতেই তারা বুঝতে পারেন, আবরার মারা গেছেন। সিঁড়িতেই মরদেহটি রেখে তখন ওই স্থান ত্যাগ করেন তারা। এরপর এ নিয়ে তারা যোগাযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে। সংশ্লিষ্টরা ঘাতকদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তোমাদের কিছুই হবে না। তোমরা হলেই অবস্থান কর। তারা ঘাতকদের রক্ষার জন্য রাতেই নানা পরিকল্পনা শুরু করেন। তবে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পরে এসব ঠুনকো পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যায়। গত বছর ১৩ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে হত্যার ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে তৈরি করা একটি ভিডিও সাংবাদিকদের দেখানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। আবরারকে কেবল শিবির সন্দেহে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল- এ প্রশ্নের উত্তরে সেদিন অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, 'শিবির হিসেবে সন্দেহের' বিষয়টি ছিল আবরারের ওপর নির্যাতনের 'একটি কারণ'। আসলে বুয়েট ছাত্রলীগের ওই নেতাকর্মীরা অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য 'উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত' হয়ে গিয়েছিল। এসব বিষয় হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেখার কথা। কিন্তু তদন্তে পুলিশ হল কর্তৃপক্ষের 'এক ধরনের ব্যর্থতা' দেখতে পেয়েছে বলে সেদিন জানিয়েছিলেন অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল।