তবুও রাস্তা দাপাচ্ছে ব্যাটারি চালিত রিকশা

প্রকাশ | ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০৪

লাইজুল ইসলাম

রাজধানীতে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। তিন চাকার রিকশায় মোটর স্থাপন করে দিব্বি রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব যান। এতে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। যদিও সরকারের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বহুবার বলেছেন এসব অটোরিকশা চলতে পারবে না। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন একই কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রাজধানীর প্রতিটি সড়কে এখন এসব রিকশার ছড়াছড়ি। হাইকোর্ট থেকে অটোরিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হলেও কোনো কার্যক্রম নিতে দেখা যায়নি রাজধানীর কোথাও। সরেজমিন দেখা যায় মিরপুর, মগবাজার, মোহম্মদপুর, তেজগাঁও, মহাখালী, বাড্ডা এলাকায় এসব অটোরিকশার বেশিরভাগেরই মালিকানা স্থানীয় প্রভাবশালীদের। ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, থানা পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় চলছে এসব অবৈধ অটোরিকশা। মগবাজারের দিলুরোডের বাসিন্দা মিলন পেশায় একজন দর্জি। তিনি অটোরিকশায় চড়ে মার্কেটে যাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় অটোরিকশাটি উল্টে যায়। সেখানেই তার জীবনের সব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যায়। দুই পা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে যায়। এরপর কয়েকবার অস্ত্রোপচার করেও আর ঠিক হয়নি তার পা। জমানো যত টাকা ছিল তা সবই শেষ হয়েছে তার চিকিৎসার পেছনে। এই ভুক্তভোগী বলেন, 'ওইদিন আমার জন্য একটি দুঃস্বপ্নের দিন। এখন সবাইকে নিষেধ করি এসব রিকশায় না ওঠার জন্য। অতিরিক্ত গতিতে চলতে পারে এসব রিকশা। তবে ব্রেক খুবই অল্প। যার কারণে আমার চালকও ব্রেক করতে পারেনি। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। আমার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার।' মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় থেকে নয়াটোলা যাওয়ার জন্য এমনই একটি রিকশায় ওঠেন শাহানা বেগম। রিকশা চালককে বার বার বলার পরও অতিরিক্ত গতিতে চলছিল রিকশাটি। এক পর্যায়ে উল্টে পড়ে শাহানার হাত ভেঙে যায়। রিকশাচালক চলে যায় আর ভাঙা হাত নিয়ে হাসপাতালে যান শাহানা বেগম। বলেন, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে হাতের তিন ভাঙা অংশ ঠিক করেছেন তিনি। এমন সব কঠিন অভিজ্ঞতা ঢাকায় খুঁজলে বের হবে হাজার হাজার। কিন্তু যাদের এই রিকশা বন্ধ করার দায়িত্ব তাদের কোনো উদ্যোগ নেই বলেই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অটোরিকশা চলাচলের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদু্যৎ। মূলত বিদু্যৎ চুরি করে চার্জ করা হয় অটোরিকশার ব্যাটারি। বিদু্যৎ বিভাগের লোকজনও এসব জানে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই বলে জানান মোহম্মদপুর বিদু্যৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় কাউন্সিলররাই চান না এসব রিকশা বন্ধ হোক। উল্টো তাদের ছত্রছায়ায় এসব রিকশার গ্যারেজ দিন দিন বড় হচ্ছে। বিদু্যৎ সংযোগ কাটা নিয়ে স্থানীয় এসব জনপ্রতিনিধিদের রোষানলে পড়তে হয় বলে জানান বিদু্যৎ বিভাগের এই কর্মকর্তা। আবার ভিন্ন দিকও আছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তাও অবৈধভাবে বিদু্যৎ সংযোগ দেওয়ায় জড়িত। যাদের কারণে লাখ বা কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ। কিন্তু কোনো ভাবনা নেই এসব কর্মকর্তাদের। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিকরা যায়াযায়দিনকে বলেন, 'আমরা একাই অবৈধ কাজ করছি না। এসব রিকশার জন্য স্থানীয় নেতা, পুলিশ, বিদু্যৎ বিভাগ এমনকি সাংবাদিকদেরও টাকা দেওয়া হয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে ১ লাখ ৬৪ হাজার রিকশা রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স পেয়েছে। এই মুহূর্তে আরও পায়ে চালিত বা অযান্ত্রিক যানবাহনের লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনো অনুমোদন নাই তাই তাদের রেজিস্ট্রেশনও দেওয়া হচ্ছে না। সূত্র আরও বলছে, লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত রিকশার একটি তালিকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে আছে। তবে অবৈধ কোনো রিকশার তালিকা নেই। এমনকি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশারও কোনো তালিকা তাদের কাছে নেই। উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, ২৮ হাজারের কাছাকাছি রিকশা এই মুহূর্তে আছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়। কিন্তু বাস্তবে লাইসেন্স ছাড়া কত রিকশা আছে তার কোনো হিসাব নেই। এমনকি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কত আছে তাও জানা নেই সিটি করপোরেশনের। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, 'ব্যাটারিচালিত রিকশা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। পায়ে চালিত বা প্যাডেলচালিত বা অযান্ত্রিক যানবাহনের লাইসেন্স দেয় সিটি করপোরেশন। কোনো যান্ত্রিক বাহনের লাইসেন্স দেওয়া হয় না। এগুলোর লাইসেন্স দেবে বিআরটিএ।' এক প্রশ্নের জবাবে এই রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, 'রাস্তায় কোনো মোটরচালিত অটোরিকশা চললে তা বন্ধের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমাদের এই দায়িত্ব নেই। যতবার বৈঠক হয়েছে ততবার পুলিশকে বলা হয়েছে লাইসেন্স ছাড়া রিকশা আপনারা আইনের আওতায় আনেন। আমরা কি করতে পারি। আর হাইকোর্টের নির্দেশ আমাদের ওপর এলে আমরা মোবাইল কোর্ট করব। কিন্তু মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর।' ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, 'সড়ক থেকে মোটর লাগানো রিকশা সরানো দায়িত্ব আমাদের। আমরা এগুলো সরানোর কাজ করছি। গত মে-জুন থেকে আমাদের অভিযানও চলছে। প্রচুর রিকশা আমরা ডাম্পিং করেছি। মোটর খুলে রাখা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সড়কে এগুলো দেখা যায়।' মুনিবুর রহমান বলেন, 'এই রিকশাগুলোর উৎস বন্ধ করতে হবে। যাতে কোনো ধরনের পার্টস দেশে আমদানি করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যারা দেশে রিকশার এসব পার্টস ইমপোর্ট করে তাদের আগে এসব আনা বন্ধ করতে হবে। না হলে অবৈধ মোটরচালিত অটোরিকশা বন্ধ করা সম্ভব না।' অবৈধ অটোরিকশা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে হবে। লিখিত, ছবি, ভিডিও বা ভয়েস রেকর্ড একটা দিতে হবে। যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এই অভিযোগ পাওয়া যাবে তাকেই বিভাগীয় মামলার আওতায় আনা হবে।' ঢাকা ইলেকট্রিক সাপস্নাই কোম্পানি লিমিটেড ডেসকোর চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন অটোরিকশায় অবৈধ বিদু্যৎ সংযোগ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, 'আমি নতুন এসেছি। আমি কিছুই জানি না। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট লোক আছে তার সঙ্গে কথা বলেন।' ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, 'বিদু্যতে চালিত এসব অটোরিকশার গ্যারেজ আমরা খুঁজে খুঁজে বের করে লাইন কেটে দিয়ে আসি। কিন্তু কিছুদিন পর আবার এগুলো অবৈধ লাইন সংযোগ করে ফেলে। এর সঙ্গে এলাকার কিছু প্রভাবশালী জড়িত। যাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমরা ফিল্ড পর্যায়ে কাজ করে চলেছি। এই অবৈধ লাইনের জন্য আমরা কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, 'জুরাইনে কিছুদিন আগে আমাদের এক লাইনম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। আমরা এসব অবৈধ কাজকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেব না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পুলিশও আমাদের সহযোগিতা করছে। তারা আমাদের বিভিন্ন অবৈধ লাইনের রিকশার গ্যারেজ দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা সেসব গ্যারেজের লাইন বিচ্ছিন্ন করছি।