ওমিক্রনের কালো ছায়া :উদ্যোক্তারা শঙ্কায়
ইউরোপের দেশগুলোতে থেমে গেছে রপ্তানি আদেশ বিশ্ববাজারে নতুন করে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি কনটেইনার সংকট জ্বালানির অপ্রতুলতায় উদ্যোক্তারা ধরাশায়ী
প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:২৮
সম্প্রতি করোনা মহামারির নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এমতাবস্থায় লকডাউন শঙ্কায় ভুগছে গোটা দেশবাসী। তবে বিশেষজ্ঞরা নতুনভাবে লকডাউন না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এর আগে পরপর দুই দফা লকডাউনে দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে। আগের সেই ধাক্কা সামলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, কনটেইনার সংকট, জ্বালানির অপ্রতুলতা প্রভৃতি কারণে উদ্যোক্তারা ধরাশায়ী হয়ে পড়েছেন। ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না তারা। তাই উদ্যোক্তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধেও আরও সময় চান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'তারা ভেবেছিলেন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তদুপরি, কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি, দুর্বল লজিস্টিকের কারণে অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও বাড়ালে উদ্যোক্তাদের মানসিক চাপ কিছুটা কমবে। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তির ১৫ শতাংশ জমা দিলে খেলাপি না করার নির্দেশনা আছে। চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত এই সুবিধা পাবেন উদ্যোক্তারা। অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, গত দুই-আড়াই বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখন আবার ওমিক্রনের আঘাত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় এটি সহজেই অনুমেয় যে, উদ্যোক্তারা ভালো নেই। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি নীতিকৌশলের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর মইনুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীজুড়ে জ্বালানি সংকট শুরু হয়েছে। করোনা-পরবর্তী বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তি পেতে নানাভাবে চেষ্টা করছে এবং অর্থনৈতিক প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে এই মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। এটা থেকে চটজলদি মুক্তি পাওয়া যাবে না। আবার করোনা মহামারির নতুন ধরন ওমিক্রন নতুন সংকট নিয়ে এসেছে। এদিকে, চলতি অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় চিন্তিত পোশাক মালিকরা। ইউরোপের দেশগুলোতে সংক্রমণ বাড়ায় এরই মধ্যে থেমে গেছে পোশাকের ক্রয়াদেশ। তবে ক্রেতারা নতুন করে রপ্তানি আদেশ না দিলে এবং করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে পোশাক খাতে আবারও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন মালিকরা। করোনার প্রথম ঢেউয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা বিপুল পরিমাণ পোশাকের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করেছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে আবার অর্ডার ফিরেছে। এখন নতুন করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিধিনিষেধ আরোপ হলে দেশের পোশাক খাত আবারও সংকটে পড়তে পারে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুলস্নাহ আজিম বলেন, ওমিক্রনের কারণে এখন পর্যন্ত ক্রয়াদেশ বাতিল না হলেও তারা শঙ্কিত। কারণ দ্রম্নত করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। তিনি বলেন, গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে করোনার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে। এছাড়া ইউরোপের অন্য দেশেও দ্রম্নত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। এটা নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি, কারণ আমাদের বেশিরভাগ ক্রেতাই ইউরোপের। তবে এখন পর্যন্ত ক্রয়াদেশ বাতিল হয়নি, কিন্তু ক্রয়াদেশ আর হচ্ছে না। ক্রেতাদের আগের মতো তৎপরতা এখন নেই। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস আমাদের খুব ভালো গেল। এখন যদি ঝামেলা না হয় তাহলে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা আছে সেটা আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারব। আর যদি করোনা পরিস্থিতি খারাপ হয় তাহলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারব কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ক্রেতারাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট। মহামারি কমে আসায় বিশ্বের মানুষ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ঠিক তখনই সামনে এসে হাজির ওমিক্রন। ভ্যারিয়েন্টটি যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে, ২০২১ সালের প্রথমার্ধে বিশ্ব অর্থনীতিতে গতি ফেরায় আস্থা পেয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা। তাই চাঙা হতে শুরু করে শেয়ার বাজার। কিন্তু নভেম্বর থেকে ওমিক্রনের ধাক্কা নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান অবশ্য মনে করছে ওমিক্রনের প্রভাব ততটা প্রবল হবে না অর্থনীতিতে। তবে টিকা প্রতিরোধী নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিলে পরিস্থিতি আবার ওলট-পালট হতে পারে। এদিকে, আইএমএফ বলছে, মহামারি প্রলম্বিত হলে মধ্য মেয়াদে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের বর্তমান পূর্বাভাসের চেয়ে আগামী পাঁচ বছরে জিডিপি পাঁচ দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার কমতে পারে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি দেশে অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ। তবে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ মানুষের টিকা সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রন শনাক্ত হয় গত ১০ ডিসেম্বর। এখন পর্যন্ত এই অতি সংক্রামক ধরনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ জনে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ওমিক্রনের প্রভাবে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে আরও ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় দেশে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ১২৩ জনে। একই সময়ে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৩৫৯ জন। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশে। দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৬ লাখ ৪ হাজার ৬৬৪ জনে। উলেস্নখ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার। মার্চের শেষের দিকে গণপরিবহণ বন্ধসহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বিধিনিষেধ জুলাই থেকে কিছুটা শিথিল হতে থাকে। কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর গত বছরের মার্চে পুনরায় করোনার ডেলটা ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়। আবার আরোপ করা হয় কঠোর বিধিনিষেধ। হিসাব করে দেখা যায়, বিধিনিষেধের কারণে গত বছর মোট ৮৫ দিন গণপরিবহণ বন্ধ ছিল। আগস্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। এখন আবার করোনার ওমিক্রন ধরন সারা বিশ্বেই প্রভাব বিস্তার করছে। দেশে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত সোমবার বিধিনিষেধ আরোপ করে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে, যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। বিধিনিষেধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মহামারি থেকে সুরক্ষার জন্য জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা। করোনার সংক্রমণ দ্রম্নত ছড়ানো ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য গণপরিবহণে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ। প্রাত্যহিক জীবনে হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজ করার অভ্যাস চালু রাখা।