নিয়ন্ত্রণে নেই নীতিমালা

রাজধানীর এসি বাসে 'অস্বাভাবিক' ভাড়া

কিলোমিটার প্রতি ভাড়া আদায় করছে ১০ টাকার বেশি হ কোম্পানি ভেদে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০-৮০ টাকা

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

আব্দুলস্নাহ রায়হান
রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে দিলেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। নীতিমালা না থাকায় আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো 'অস্বাভাবিক' ভাড়া আদায়ের অভিযোগ এসি বাস মালিকদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে এসি বাস সার্ভিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করছেন যাত্রীরা। এসি বাসের সেবাদাতা প্রায় সব কোম্পানির বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যাত্রীদের। এ ছাড়া বহু জায়গায় স্টপেজ থাকলেও সেভাবে ভাড়া নির্ধারণ না করে স্বল্প দূরত্বের জন্যও বেশি টাকা গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের। গণপরিবহণ সংকটের এই শহরে একটু আরামের জন্য ভ্রমণপ্রিয় মানুষ যেন পরিবহণ কোম্পানির কাছে 'জিম্মি' হয়ে পড়েছেন। এসি বাসের যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এসব বাসের নিয়মিত যাত্রীরা। সরকারের ভাড়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বলছে, আইনে না থাকায় এসব বাসের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। পরিবহণ মালিক সমিতির ঊর্ধ্বতন নেতাদের মতে, এসব সার্ভিস লাক্সারি হওয়ায় ভাড়া কিছুটা বেশি। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন রুটের এসি বাস সার্ভিসে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, নন এসি বাসের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয়গুন বেশি ভাড়া আদায় করছে এসি বাসে। ইকবাল এসি বাস সার্ভিস সাইনবোর্ড থেকে উত্তরা আব্দুলস্নাহপুর রুটে চলাচল করে। বৃহস্পতিবার এই কোম্পানির ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৭৪৫৪ বাসে সাইনবোর্ড থেকে চড়ে উত্তরা পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেছে, এই রুটে ২০ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৩০ টাকা। বাসে চড়ে নিকট-দূরত্বে যেখানেই যাত্রী নামুক না কেন, ৫০ টাকা নির্ধারিত ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই বাসে মোট সিট রয়েছে ৪০টি। দেখা গেছে, সাইবোর্ড থেকে মানিকনগর, মুগদা, বাসাবোর ভাড়া ৫০ টাকা রাখা হচ্ছে। এরপর মালিবাগ, রামপুরার ভাড়া ৭০ টাকা। সাইনবোর্ড থেকে নতুন বাজার ৮০ টাকা, কুড়িল বিশ্ব রোড ১০০ এবং খিলখেত পর্যন্ত ১১০ টাকা ভাড়া। মাঝখানে যেকোনো জায়গায় নামলে সামনের স্টপেজের ভাড়া দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। তেমনি মতিঝিল থেকে আব্দুলস্নাহপুর রুটে চলাচলকারী গ্রিন ঢাকা এসি বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া এখন ৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ১৩০ টাকা। আগে এই বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ৬০ টাকা, সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। জ্বালানির দাম বাড়ার পর এই বাস সার্ভিসে স্টপেজপ্রতি ২০ টাকা ভাড়া বাড়িয়েছে। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে এসব বাসে যাত্রী উঠে থাকে। এরপর থেকে যেকোনো দূরত্বে নামলেই ভাড়া ৮০ টাকা দিতে হচ্ছে। গ্রিন ঢাকা পরিবহণের বাসের মতিঝিল থেকে গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, রামপুরা বাজার, রামপুরা ব্রিজ, নতুন বাজার, বসুন্ধরা পর্যন্ত কাউন্টার আছে। এদিকে দেখা গেছে, কিলোমিটারের হিসাবে সবচেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া হয় গুলশান-বনানী এলাকার 'ঢাকার চাকায়'। গুলশানে চলাচলরত 'ঢাকার চাকা' নামে এসি বাস সার্ভিসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। স্বল্প দূরত্বে এক কিলোমিটারের কম জায়গা অতিক্রম করলেও এই বাসে ৩০ টাকা ভাড়া আদায় করছে। এদিকে, গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী শীতল এসি বাসে যেকোনো জায়গায় নামলে ভাড়া নিচ্ছে ৭০ টাকা। আগে ভাড়া নেওয়া হতো ৫৫ টাকা। এই বাসে সিট রয়েছে ৫০টি। বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে আশপাশের জেলায় চলাচলকারী এসি বাসের সংখ্যা কয়েকশ। আর বিআরটিসির বহরে নতুন-পুরনো মিলিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের সংখ্যা ৪১৩টি। রাজধানী ও রাজধানীর আশপাশের কয়েকটি রুটে এসব বাস চলাচল করে। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া হিসাব করে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম ভাড়া বিআরটিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে। জানা গেছে, মতিঝিল থেকে ফার্মগেট হয়ে আবদুলস্নাহপুর পর্যন্ত ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার পথে বিআরটিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া ৮০ টাকা। প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া তিন টাকা ৫০ পয়সা। এই বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া রাখা হয়েছে। মতিঝিল থেকে গুলিস্তান, রামপুরা হয়ে উত্তরা দিয়াবাড়ি খালপাড় পর্যন্ত বিআরটিসির আরেকটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা রয়েছে। এই রুটের ভাড়া ৯০ টাকা, কিলোমিটার প্রতি ভাড়া তিন টাকা ৯৭ পয়সা। এতে সর্বনিম্ন ভাড়া রাখা হয় ৩০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া রাখা হয়। মতিঝিল থেকে সাভার পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দূরত্বে লাল-সবুজ পরিবহণের ভাড়া ১৪০ টাকা। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পাঁচ টাকা ২০ পয়সা। এই বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা। মতিঝিল থেকে মানিকগঞ্জের দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। মানিকগঞ্জ এসি লিংক পরিবহণের বাসের ভাড়া রাখা হয় ২৫০ টাকা। প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া আসে তিন টাকা ৮০ পয়সা। এই বাসে ২০০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই। গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। এই পথে বিআরটিসি পরিবহণের ভাড়া ৬৫ টাকা। কিলোমিটার প্রতি তিন টাকা ৮০ পয়সা ভাড়া আসে। এসি বাস সার্ভিসে বাসগুলোর অনেকগুলো কাউন্টার থাকলেও সেভাবে ভাড়া নির্ধারণ না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন যাত্রীরা। ইকবাল বাসে সাইনবোর্ড থেকে মুগদা হাসপাতালের সামনে আসতে আবিদ নামে একজন যাত্রীকে ৫০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। অথচ এই দূরত্বে নন-এসি বাসে ২০ টাকারও কম ভাড়া নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবিদ। তিনিসহ বাসের একাধিক যাত্রী ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, যাত্রাপথে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব স্টপেজে থামলেও সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা নিচ্ছে ইকবাল পরিবহণ। কম দূরত্বে চলাচলকারী যাত্রীরাই এসব বাসে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের। রামপুরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আল রাজু বলেন, গণপরিবহণ মালিকদের কাছে আমরা যাত্রীরা সবাই জিম্মি। নইলে উঠলেই ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হবে কেন? তারা যদি সাইনবোর্ড থেকে ছেড়ে সোজা আব্দুলস্নাহপুর চলে যেত, অন্য কোথাও থেকে যাত্রী না উঠাত, তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু এই বাস সব স্টপেজ থেকেই যাত্রী তোলে। তিনি আরও বলেন, 'মানুষ একটু আরাম ও সময় বাঁচাতে এসি বাসে চড়ে। এ জন্য যা খুশি তাই ভাড়া আদায় করবে?' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রিন ঢাকা পরিবহণের একজন পরিচালক বলেন, 'যাত্রীদের ভালো মানের সেবা দিতেই ভাড়াটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।' যাত্রীদের চাহিদার কারণেই বেশি কাউন্টার এবং ভাড়ার বেশি ধাপ রাখা হচ্ছে না। তিনি বলেন, 'আমরা প্রথমে ভাড়ার কয়েকটি সস্ন্যাব করেছিলাম। কিন্তু আমাদের এই গাড়ির বেশিরভাগ যাত্রীই উত্তরা এলাকার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন এমন। তারা চায় না, অনেকগুলো স্টপেজ থাকুক। তারা কাউন্টার কম রাখার জন্য বলেন।' তিনি আরও বলেন, 'এসি বাস অনেক বেশি আরামদায়ক। দামও সাধারণ বাসের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সরকারকে ভ্যাটও দিতে হয় সবচেয়ে বেশি। এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, জ্বালানি খরচও বেশি। সবকিছু হিসাব করে আমরা ভাড়া নির্ধারণ করেছি।' বিআরটিএর রোড সেফটি ডিপার্টমেন্টের পরিচালক মাহবুব ই রাব্বানি বলেন, এ দেশে এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণে আইনগত জটিলতার কারণে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিআরটিএ পুরনো আইনের সংশোধন বা সংযোজনের কাজ করছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে, এসব বাসের ভাড়া নিয়ে আর যাত্রীদের অভিযোগ থাকবে না এবং সড়কে লাক্সারি বাস সার্ভিসে একটা শৃঙ্খলা আসবে।'