শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
মালিক সমিতি ও পুলিশকে ম্যানেজ

রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রুট পারমিট ছাড়া বাস

চাঁদা ও মাসোয়ারা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ঢালাওভাবে রুট পারমিট দিচ্ছে বিআরটিএ
ম আব্দুলস্নাহ রায়হান
  ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১০

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেবে রাজধানীর সড়কে বৈধ ২৯১টি রুটে বর্তমানে সিটি বাস হিসেবে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৩০ হাজার ২৭৪টি। এসব বাসের অধিকাংশই এখন আর রাজধানীতে চলাচল করছে না। নির্ধারিত রুটের বাইরে ১ হাজার ৬৪৬টি বাস রুট পারমিট ছাড়া চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে সরকারি নথিতে। এসব রুট পারমিটহীন বাসের জন্য রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা চলছে। প্রতিনিয়ত অবৈধ বাসের সংখ্যা বাড়ার কারণে সড়কে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহণ মালিক সমিতি ও স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা ও বিআরটিএর কতিপয় কর্মকর্তাকে মাসোহারা দিয়েই রুট পারমিট ছাড়াই রাজধানীর সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিপুলসংখ্যক বাস। রুট পারমিটহীন বাস বন্ধের জন্য লোক দেখানো কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা পুলিশের নামমাত্র জরিমানা দিয়ে এসব বাস কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বেপরোয়াভাবে যাত্রী পরিবহণ করছে। এজন্য সড়কে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। বিআরটিএ ও সিটি করপোরেশন থেকে বারবার রুট পারমিট ছাড়া বাসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়ার কারণে সড়কে এসব অবৈধ বাস নিয়মিত চলছেই। জানা গেছে, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি নগর পরিবহণ সেবা চালুর পর চলতি মাসে কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এতে সামান্য জরিমানা করে রুট পারমিটহীন বাস ছেড়ে দেওয়া হয়। কমিটির গত ২৮ নভেম্বরের সভায় জানানো হয়েছিল, রাজধানীতে রুট পারমিট ছাড়া ১ হাজার ৬৪৬টি বাস আর চলতে দেওয়া হবে না। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, বিআরটিএর কর্মকর্তারা অবৈধভাবে লাভবান হয়ে ইচ্ছেমতো রুট পারমিট দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী, রুট পারমিট পেতে বাস মালিকদের জন্য নির্ধারিত কোনো নিয়মনীতি নেই। বিআরটিএ অফিসে নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ফিসহ মোটরযানের জন্য রুট পারমিট ইসু্য/নবায়নের জন্য আবেদন করতে হয়। এরপর বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ আবেদন যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেলে আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটিতে (আরটিসি) উপস্থাপন করা হয়। কমিটিতে অনুমোদিত হলে সদস্য সচিব (সহকারী পরিচালক) রুট পারমিট ইসু্য/নবায়ন করে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন বাস-মিনিবাস নামানো অসম্ভব। একটি বাস নামাতে হলে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবহণ মালিক সমিতিগুলো। কয়েক লাখ টাকা চাঁদা দিয়েই মালিক সমিতির সদস্যপদ নিতে হয়। মালিক সমিতিকে চাঁদা না দিয়ে রুট পারমিটের জন্য আবেদন করা হলে নানা অজুহাতে তা ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। রুট পারমিট না পেলেও এসব বাস গ্যারেজে বসে থাকে না। সড়কে নেমে বছরের পর বছর যাত্রী পরিবহণ করছে। সড়ক নিয়ে কাজ করা সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, রুট পারমিট পাওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিআরটিএ এবং পরিবহণ মালিক সমিতির লোকজন এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তারা সততার সঙ্গে পারমিট দিলে ঢাকার সড়কে রুট পারমিট ছাড়া বাস চলত না। ইচ্ছে করে রুট তৈরি করলে যানজট ও বিশৃঙ্খলা কমানো যাবে না বলেও মনে করেন সংস্থাটির নীতিনির্ধারকরা। অভিযোগ রয়েছে, একটি রুটের বাস চলাচল বন্ধ করলে নাম পরিবর্তন করে অন্য রুটে চালানো হচ্ছে। নগর পরিবহণ চালুর পর ঘাটারচর থেকে চিটাগাংরোড রুটে রজনীগন্ধা ও সিটি লিংক পরিবহণের রুট বাতিল করা হয়। তবে নাম পরিবর্তন করে প্রায় ১৬১টি বাস একই রুটে চলাচল করছে। এমনকি এসব বাসের পূর্বের ওয়েবিল প্রথার নামে বেশি ভাড়া আদায়ের অপকৌশলও চলমান রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘাটারচর-চিটাগাং রুটে রজনীগন্ধা পরিবহণ ও সিটি লিংক পরিবহণের ১৬১টি যাত্রীবাহী বাস এখনো চলছে। আর এসব বাসের নামও পাল্টে গেছে। বর্তমানে সময় নাম নিয়ে এসব বাস একই পদ্ধতিতে চলছে। মঙ্গলবার রজনীগন্ধা পরিবহণ ও সিটি লিংক পরিবহণ কোম্পানি দুটির কয়েকটি বাসের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগর পরিবহণের বাস চলার কারণে এই রুটের বাসে যাত্রী পরিবহণ বন্ধ করে দিয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। তবে ম্যানেজ করেই এই রুটে রজনীগন্ধা ও সিটি লিংক এখনো চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, তারা রজনীগন্ধা ও সিটি লিংকের বাসগুলোকে রুট রেশনালাইজেশন প্রক্রিয়ায় যোগ করতে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কমিটি তা গ্রহণ করেনি। এটি নিয়ে পরিবহণ মালিক সমিতির সঙ্গে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির কথা চলছে। তিনি বলেন, সমিতির বাইরে গিয়ে সরকার এককভাবে কোনো কিছু করতে চাইলে বা চাপিয়ে দিলে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা আসবে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, রুট পারমিটহীন বাস চলাচল বন্ধে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তবে পুলিশ জরিমানা করতে পারে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকলে সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি আইন প্রয়োগ করা যায়। বাস রুট রেশনালাইজেশনের ২০তম সভায় মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, রুট পারমিট ছাড়াই বছরের পর বছর ঢাকার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির বাস। নেই ফিটনেস সার্টিফিকেট। তারপরও তারা ইচ্ছেমতো রুট ব্যবহার করে যাত্রী পরিবহণ করছে এবং ভাড়া বাড়াচ্ছে। আবার রুট পারমিট পেতে পরিবহণ মালিক সমিতি এবং বিআরটিএর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। তবে এবার রুট পারমিট ছাড়া ঢাকার রাস্তায় কোনো বাস চলতে পারবে না। আগামী ১ জুলাই থেকেই রুট পারমিটবিহীন বাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উলস্নাহ জানান, 'সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের সঙ্গে আমরাও কাজ করছি। রুট পারমিট ছাড়া কোনো বাস চলুক এটা আমরাও চাই না। বর্তমানে রাজধানীতে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের জানানো হয়নি। বিআরটিএ বলতে পারবে। রুট পারমিটের জন্য মালিক সমিতিতে কোনো বাস মালিককে এখন আর চাঁদা দিতে হয় না। সবকিছু কাগজপত্র এবং বিআরটিএর ওপর নির্ভর করে।' ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট পস্ন্যানার ধ্রম্নব আলম জানিয়েছেন, 'ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে রজনীগন্ধা ও সিটি লিংকের যেসব বাসের রুট পারমিট রয়েছে সেগুলোকে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে অন্য রুটে চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। বাকি বাসগুলো যে রুটের অনুমোদন নেওয়া সেখানে চলাচল করবে। তিনি বলেন, রুট পারমিট ছাড়া নির্ধারিত রুটে বাস চালানো অবৈধ। বিআরটিএর সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই-রাব্বানী বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে বাসের রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। কেননা, নগর পরিবহণের আওতায় সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পূর্বের রুট সমন্বয় করে ৪২টি রুটে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে ঢাকার সব বাস কোম্পানিকে একত্র করে ২২টি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে