শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টিকার সুফলে মৃত্যুহারে লাগাম

করোনায় আগের তুলনায় মৃতু্যর হার ২০ গুণ কম হ ৮০ শতাংশ টিকা দেওয়ার টার্গেট, এখনো অনেক বাকি হ পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছেন মাত্র ৩৩.৭১ শতাংশ মানুষ হ টিকাদানের গতি বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১০:২৭

ওমিক্রনের প্রভাবে গত দুই সপ্তাহে দেশে করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও সে তুলনায় মৃতু্যর হার এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে অন্তত এক ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসায় মৃতু্য হারে লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে। তবে টিকাদান কর্মসূচির গতি আরও দ্রম্নত বাড়াতে হবে। তা না হলে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যার সঙ্গে পালস্না দিয়ে মৃতু্যর হার বাড়বে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, যেভাবে প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে আগামী সপ্তাহ নাগাদ দৈনিক সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে জানুয়ারির শেষভাগে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যা সামাল দেওয়া দুষ্কর হবে। এতে বর্তমান সময়ের মতো মৃতু্যহার নিয়ন্ত্রণে না থাকার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৮৪ হাজার ৮১৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত এক ডোজ পেয়েছেন ৮ কোটি ৯১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৭৯ জন। তাদের মধ্যে ৫ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার ৮৩৪ জন দুই ডোজ নিয়ে কোর্স পূর্ণ করেছেন। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার (১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার) ৫২ দশমিক ৭২ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছেন ৩৩ দশমিক ৭১ শতাংশ মানুষ। এ হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে পূর্ণ ডোজ টিকার আওতায় আনার সরকারের যে টার্গেট রয়েছে, সেখান থেকে দেশ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যা দ্রম্নততম সময়ে পূরণ করা জরুরি। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনায় মৃতু্যর হার যে অনেকাংশে কমেছে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ডো মিটার্সের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১০ ফেব্রম্নয়ারি মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪৮ জন। এদিন করোনা আক্রান্ত ১০ জনের মৃতু্য ঘটে। অথচ চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি (২৪ ঘণ্টায়) দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার ছাড়ালেও মৃতু্য সংখ্যা ছিল ১০ জন। অর্থাৎ আগের তুলনায় মৃতু্যর হার ২০গুণ কম। শুধু এই একদিনই নয়, গত বছরের ফেব্রম্নয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে একই চিত্র পাওয়া গেছে। গত বছরের ১৫ মার্চ শনাক্ত ও মৃত রোগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৮৫ জন ও ৮ জন। একই বছরের ৩১ মার্চ করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৫৮ জন এবং মারা যান ৫২ জন। ১৫ এপ্রিল শনাক্ত রোগী ৪ হাজার ১৯২ জন; মৃতের সংখ্যা ৯৪ জন। ৩০ এপ্রিল শনাক্ত রোগী ছিল ২ হাজার ১৭৭ এবং মৃত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৫ জন। পরে করোনা নিম্নমুখী হয়ে ১৪ মে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৮৪৮ জন। তবে এদিন মারা যায় ৩১ জন। ৩১ মে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৬৫ জন; মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৬ জন। গত বছরের জুনের পর করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। ১৫ জুন দেশে ৩ হাজার ৩১৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয় এবং এদিন মারা যায় ৫০ জন। ১ জুলাই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লাফে ৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এদিন দেশে ৮ হাজার ৩০১ জন রোগী শনাক্ত করা হয় এবং মৃতু্য সংখ্যা ছিল ১৪৩। যা মাস শেষে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২৮ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ শনাক্ত রোগীর রেকর্ড তৈরি হয়। এদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ২৩০ এবং মৃতু্যর সংখ্যা ছিল ২৩৭ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হওয়ায় মৃতু্যর হার কমার চিত্র স্পষ্ট। তবে সংক্রমণ অতিমাত্রায় বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এখনো দেশের কয়েক কোটি মানুষ টিকা নেয়নি। ফলে এ নিয়ে স্বস্তিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে কিছুটা নির্ভার হতে হলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে দ্রম্নত টিকার আওতায় আনতে হবে। আর এজন্য দ্রম্নত টিকার গতি বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে গতিতে টিকাদান কর্মসূচি এগোচ্ছে তা সন্তোষজনক নয় বলেও মনে করেন তারা। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল যায়যায়দিনকে বলেন, দ্রম্নত টিকাদান সংক্রমণ ও মৃতু্যর হার উভয়ই হ্রাস করবে। তবে আমাদের টিকা প্রয়োগের হার খুবই কম। যদি দেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষকে দুই ডোজের টিকার আওতায় আনা সম্ভব হতো, তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমত। এ অবস্থায় দ্রম্নত সময়ে শতভাগ টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করা জরুরি দাবি করে তিনি বলেন, একজন মানুষও টিকার বাইরে থাকলে পরে তিনি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। এর বাইরে একমাত্র অবলম্বন হলো স্বাস্থ্যবিধিসহ সামাজিক রীতিগুলো পালন করা। এ ছাড়া আক্রান্ত শনাক্তে পরীক্ষার হার খুবই কম। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন লাখ নমুনা পরীক্ষা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বজুড়েই করোনা মোকাবিলায় টিকার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে টিকা কার্যক্রমে গতি বাড়ছে না। বর্তমানে সরকারের কাছে প্রায় ৯ কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী টিকাদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার কথা বললেও সার্ভার জটিলতাসহ নানাবিধ কারণ ও আইসিটি খাতের দুর্বলতায় টিকা কার্যক্রম গতি পাচ্ছে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ইতোমধ্যে বিশ্বকে ওমিক্রনের ঝুঁকি বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, এতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমাদের মতো দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দেশে টিকাদান কর্মসূচি শক্তিশালী করার ওপর আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত। কারণ টিকা হাসপাতালে ভর্তি ও মৃতু্য কমাবে। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি ও বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার তাগিদ দেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, গত মাসের শেষে দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হলেও সার্ভারসহ নানাবিধ জটিলতা ও আইসিটি খাতের দুর্বলতায় এর কার্যক্রমও গতি পায়নি। গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৮৮৭ জনকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে। অথচ ষাটোর্ধ্ব ঝুঁকিতে থাকা প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বুস্টার ডোজের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তারা এসএমএসও পাচ্ছেন না, টিকাও নিতে পারছেন না। প্রসঙ্গত, মহামারি করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে ভ্যাসকিন বা টিকা নেওয়া বলে দাবি করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা টিকার দু'ডোজ নেওয়া মানুষদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃতু্যর হার ০.০০১ শতাংশেরও কম। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসির তথ্য বিশ্লেষণ করে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সিএনএন। প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষকে পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি বা কেউ মারা যাননি। এদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার সাত শতাংশ এবং টিকা না নেওয়া রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার ২৩ শতাংশ। গবেষণা তথ্যে আরও বলা হয়েছে, অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত টিকা না নেওয়া করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার ৩২ শতাংশ এবং পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া রোগীদের ভর্তির হার ১০ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, একের অধিক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত টিকা না নেওয়া করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। করোনা আক্রান্ত রোগীদের জাতীয় তালিকা থেকে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ত্রিশোর্ধ্ব এক হাজার ৩৩৪ জনের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে দেখা গেছে, টিকা না নেওয়া রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতার হার ছিল ১১ শতাংশ। অন্যদিকে পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণ পরবর্তী আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই হার চার শতাংশ। অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত টিকা না নেওয়া করোনা রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতার হার পূর্ণ ডোজ টিকাগ্রহণ পরবর্তী আক্রান্তদের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে