শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত দেশ

কপালে ভাঁজ ফেলেছে ওমিক্রন

সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ওমিক্রনের প্রভাবে দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা। গত ৭ জানুয়ারি থেকে মাত্র দু'সপ্তাহের ব্যবধানে এ মরণব্যাধিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে এখন ১১ হাজারের ঘর ছুঁইছুঁই। তাই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনের। ওমিক্রন থাবায় রাতের ঘুম উড়েছে সব পেশার সচেতন মানুষের।

এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন সবার মনেই একই প্রশ্ন- বিদু্যৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এ ভ্যারিয়েন্টের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে কতটা প্রস্তুত দেশ? ওমিক্রনের বড় ঢেউ দেশে আছড়ে পড়লে এবারও কি ফের আইসিইউ, অক্সিজেন ও ন্যাজাল ক্যানুলাসহ চিকিৎসা সরঞ্জামের হাহাকার দেখা দেবে? চিকিৎসা সেবার অভাবে কি ফের মৃতু্যহারে অধিক গতি পাবে?

স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব না দিলেও এ ব্যাপারে কিছুটা আশ্বস্ত করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, প্রায় দু'বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব আজ ওমিক্রনের সঙ্গে লড়াইয়ে কিছুটা হলেও বিগত বছরগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালীন করোনা সম্পৃক্ত অনেক তথ্যই অজানা ছিল চিকিৎসকদের। বিগত প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ থেকে শিক্ষা নিয়ে ওমিক্রন পরিস্থিতি যথাযথভাবেই সামলে উঠতে পারবেন বলেই আশাবাদী চিকিৎসকরা। সেই সঙ্গে রয়েছে করোনা টিকা। ইতোমধ্যেই ১৫ কোটি টিকার মাইলফলক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে বলা হয়েছে, টিকা নেওয়ার ফলে ওমিক্রনের উপসর্গ ডেল্টার থেকেও অনেক মৃদু। ইতোমধ্যেই দেশের প্রবীণ বা ষাটোর্ধ্ব নাগরিক যাদের কোমর্বিডিটি আছে, তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছোটদের টিকা দানের ফলে পরিস্থিতি আরও কিছুটা সামাল দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্ব টিকার ওপর ভর করে কিছুটা হলেও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে করোনা পরিস্থিতি ঠেকাতে অনেক সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে ফল হতে পারে ভয়াবহ এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও)।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ভ্যাকসিনের পাশাপাশি, নতুন বছরে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার মূলধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে; ইতিবাচক আরও কিছু ব্যবস্থা পাইপলাইনে রয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ওষুধকে করোনা চিকিৎসায় জরুরি ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এসব ওষুধ কোভিড নিরাময়ে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। কোভিডের গুরুতর উপসর্গ প্রকাশের পাঁচ দিনের মধ্যে এসব ওষুধ সেবনে যথেষ্ট ভালো ফল মিলছে।

এর সঙ্গেই বিজ্ঞানীদের ধারণা ওমিক্রনের হাত ধরেই, মহামারি শেষের শুরুটা হতে চলেছে। এ ভাইরাস সম্পূর্ণ নির্মূল না হলেও ভ্যাকসিন এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় এটিকে বেশখানিকটা রুখে দেওয়া সম্ভব হবে। তার আগে ওমিক্রনকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এদিকে, হাসপাতালগুলোতে সব প্রস্তুতি সেরে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়েছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর পূর্ব নির্ধারিত শয্যার পাশাপাশি প্রয়োজনে যাতে আরও অধিক সংখ্যক বেড বাড়ানো যায় তার প্রস্তুতি রাখার তাগিদ রয়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়লে অক্সিজেন ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বাড়ানোরও আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে। আগামী ৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত স্কুল, কলেজ ও সমপর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকের আশঙ্কা, এসব প্রস্তুতি ওমিক্রণের ভয়াল থাবা কতটা রুখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তাদের ভাষ্য, গত ৭ জানুয়ারি দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৪৬ জন থাকলেও ২০ জানুয়ারি তা ১০ হাজার ৮৮৮ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, করোনার তৃতীয় ঢেউ অতি আসন্ন। অথচ অথচ এখনো দেশে বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্কই ওঠেনি। শহর কিংবা গ্রামে সর্বত্রই একই চিত্র বিরাজ করছে। এছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সরকার কঠোর নির্দেশনা দিলেও এর সবই উপেক্ষিত হচ্ছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে 'জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট' থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।

তবে দেশে নতুন করে করোনার বিস্তারের পর থেকেই সরকারি ও বেসরকারিভাবে মাস্ক পরার বিষয়ে নানা সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কাছে উপেক্ষিত রয়েই গেছে। দেশের হাটবাজার, মার্কেট, লঞ্চ, ফেরি ও গণপরিবহণগুলোতে এ চিত্র স্পষ্ট।

এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, মানুষ নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে স্ব-উদ্যোগেই মাস্ক পরবে, স্বাস্থ্যবিধি মেলে চলবে এবং কেউ মাস্ক না পরলে সামাজিকভাবেই তাকে বাধ্য করা হবে এমনটা সারাদেশে শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সামাল দেওয়া যাবে। এতে কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগ বা লকডাউন দেওয়ারও প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সংস্থাটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাক্তার মুশতাক হোসেন এ ব্যাপারে যায়যায়দিনকে বলেন, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নেই। শহর কিংবা গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক পরছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশিত ১১ দফার মধ্যে রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহণের জন্য যেসব নির্দেশনা ছিল সেগুলোর বালাই নেই। স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি করতে কেবল নির্দেশনাই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। কাউকে একক দায় দিয়ে লাভ নেই। মানুষকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই করোনার আরেকটি ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মাস্ক পরার বিষয়ে কঠোরতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধ বৃদ্ধির কৌশল নিয়েও সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। সরকারি উদ্যোগ ও সচেতনতায় অধিকসংখ্যক মানুষ এখন নিজের কাছে মাস্ক রাখছে। এটিও এক ধরনের সফলতা বা অগ্রগতি। এখন সেই মাস্ক যেন সঠিক জায়গায় সঠিক নিয়মে মানুষ পরে, সে বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সচেতনতামূলক কার্যক্রম বা উদ্যোগ হাতে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা খুবই কম। তাদের দ্রম্নত বিধিনিষেধ মেনে চলার আওতায় আনতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব সবার আগে নিজেদেরই। সেটি করতে হলে মাস্ক পরতে হবে। আর মাস্ক পরতে ব্যক্তির সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এ (পিএনএএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারির বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক পরিধান করা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ইতালি ও নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের এই দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হারও প্রতিদিন ৩ শতাংশ করে হ্রাস পেয়েছিল।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিয়োজিতরা বলছেন, দ্রম্নত সংক্রমণ ছড়ানোর ওমিক্রনের বিস্তারে করোনার টিকা নেওয়া মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা মানুষকে মাস্ক পরিধান করার আহ্বান জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর সর্বশেষ নির্দেশনায় মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনায় কাপড়ের একাধিক স্তরের মাস্ক, আঁটসাঁটভাবে আটকানো এবং নাক পুরোপুরি ঢেকে রাখতে পারে এমন মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কাপড়ের মাস্কের নিচে বহুস্তরের একবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক পরা যেতে পারে। এন-৯৫ মাস্ক চিকিৎসাকর্মীদের পরিধান করার কথা বলা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য ডাক্তার আবু জামিল ফয়সাল জানান, জনসমাগম থেকেই আবার করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ১১ দফা সুপারিশে কাজ হবে না। দেশের জনগণের স্বভাব পরিবর্তনের পরামর্শ দেয় এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে