হাসপাতালে শয্যা নিয়ে হাহাকারের শঙ্কা
মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে ঢাকার সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় ১৭.৯১ শতাংশ এবং আইসিইউতে ৯.৮৪ শতাংশ রোগী বেড়েছে। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি বেড়েছে সাধারণ শয্যায় ১৫.৫৮ এবং আইসিইউতে ৭.২৬ শতাংশ। ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর ২৭.৫৭ শতাংশ এবং রাজশাহীর ২৬.১২ শতাংশ সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে
প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১৬
করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম ভাগে হাসপাতালের ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ শয্যা খালি থাকলেও মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তা কমে ৭২ শতাংশে এসে ঠেকেছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিনই ৫ থেকে ৭ শতাংশ শয্যায় নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ফেব্রম্নয়ারির মাঝামাঝিতেই ফের সাধারণ শয্যা ও আইসিইউর হাহাকার দেখা দেবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়লে করোনায় মৃতু্যর হারও ঊর্ধ্বমুখী হবে।
দেশের জেলা শহরগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে কোভিডে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়বে। শয্যা, আইসিইউ, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন সংকটে স্বাস্থ্য সেবায় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাই বিগত সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনায় রেখে মাস্ক পরিধানসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর ৩ হাজার ১৪৫টি সাধারণ শয্যার মধ্য ২ হাজার ৮৪১টি খালি ছিল। এ হিসাবে সাধারণ শয্যা ৯.৬৬ শতাংশ রোগী ভর্তি ছিল। এসব হাসপাতালের ৩৭৬টি আইসিইউর মধ্যে খালি ছিল ৩৩০টি। অর্থাৎ ১২.২৩ শতাংশ আইসিইউতে গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। একই দিন ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সাধারণ শয্যার ৯১.১০ শতাংশ এবং আইসিইউর ৮৯.২৭ শতাংশ খালি থাকার তথ্য রয়েছে। অথচ গত ২০ জানুয়ারি ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর ২৭.৫৭ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং ২২.০৭ শতাংশ আইসিইউতে রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। এদিন ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ২৪.৪৮ শতাংশ সাধারণ শয্যা ও ১৭.৯৯ শতাংশ আইসিইউতে রোগী ভর্তি ছিল। উপরোক্ত দুই দিনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে ঢাকার সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় ১৭.৯১ শতাংশ এবং আইসিইউতে ৯.৮৪ শতাংশ রোগী ভর্তি বেড়েছে। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি বেড়েছে সাধারণ শয্যায় ১৫.৫৮ এবং আইসিইউতে ৭.২৬ শতাংশ।
কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথমদিকে রোগী ভর্তির হার ধীরে ধীরে বাড়লেও তা এখন দ্রম্নত গতি পেয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এরই মধ্যে হাসপাতালের বেড এক-তৃতীয়াংশ ভরে গেছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ঢাকা শহরের সব হাসপাতালেই আর খালি শয্যা পাওয়া যাবে না। হাসপাতালে যে অবস্থা চলছে সেটা আশঙ্কাজনক। তাই আগে থেকেই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। এদিকে ২০ জানুয়ারি ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশে রোগী ভর্তি থাকলেও চট্টগ্রামে মাত্র ৯.৩৯ শতাংশ, রংপুরে ২.৭৮ শতাংশ, খুলনায় ৪.৯৩ শতাংশ, বরিশালে ৩.২৩ শতাংশ সাধারণ শয্যায় করোনা রোগী ভর্তি ছিল। যদিও এদিন রাজশাহীতে ২৬.১২ শতাংশ ও সিলেটে ১৪.৪৪ শতাংশ সাধারণ শয্যা করোনা রোগী চিকিৎসাধীন থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তির পরিসংখ্যান চিত্র সাধারণভাবে বিশ্লেষণ করলে দেশের কোন বিভাগে করোনা সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার তুলনামূলক তথ্য পাওয়া যায়। এ হিসাবে দেখা যায়, ঢাকার পর রাজশাহী ও সিলেটে বিভাগে রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। তবে অন্যান্য বিভাগে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার এখনো অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। তাদের ভাষ্য, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের অনেক জেলাতেই সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও ততটা ভালো নয়। এ কারণে বিত্তশালী ও সামর্থ্যবানরা অনেকে করোনায় আক্রান্ত হলেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে ছুটে আসেন। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষের ভরসা রাজশাহীর সরকারি হাসপাতাল। তাই সেখানে রোগীর চাপ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। গত বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বাড়লে এবারও সেই একই দশা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে যে হারে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে সহসা তা কমবে না। তাদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। এভাবে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে আইসিইউ পাওয়া তো দূরের বিষয়, কোভিডের সাধারণ শয্যাও পাওয়া যাবে না। জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য ডক্টর আবু জামিল ফয়সাল যায়যায়দিনকে বলেন, আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার সংকট হবে এটি নতুন কিছু নয়। এটি মোকাবিলায় 'রোগী ব্যবস্থাপনার' ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যাদের অক্সিজেন লেভেল ৮০ থেকে ৮৫ এর মধ্যে থাকবে, তাদের নিয়ে যেতে হবে অস্থায়ী করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। সেখানে তারা প্রতিদিন ২-৩ লিটার অক্সিজেন পেলে সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাদের মধ্যে যাদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে তাদের বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। তাহলে হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে তিনি বলেন, একজন করোনা পজিটিভ রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি জোর দিতে হবে। কারণ, করোনা হলেই যে হাসপাতালে যেতে হবে এমন নয়। তাকে মানসিকভাবে শান্ত রাখতে হবে। অস্থিরতা কমিয়ে বাসায় সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায় রেখেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং ভালো খাবারের ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে রোগী বাসায় বসেই দ্রম্নত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এভাবে ২০ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। এদিকে বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের দিকে নজর দেওয়া জরুরি বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন। তাদের ভাষ্য, করোনা রোগীদের চাপ বিভাগীয় ও রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো থেকে কমাতে এখনই উপজেলা ও জেলাপর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারকে নজর দিতে হবে। তাদের মতে, গ্রামপর্যায়ে দুর্বার গতিতে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করলে দলে দলে মানুষ আক্রান্ত হয়ে উপজেলা ও জেলার হাসপাতালে ছুটে যাবেন। সেখানে ভর্তি হয়ে সাধারণ চিকিৎসা পেলেও যে-ই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়বে তখনই তৈরি হবে সংকট। কারণ, অধিকাংশ জেলা ও উপজেলার হাসপাতালে করোনা রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার মতো সুব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক রোগী শুধু অক্সিজেন সেবার জন্য ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ছুটবেন। এত রোগী একসঙ্গে এক জায়গায় ছুটে আসায় ভয়াবহ সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড চিকিৎসক ও সহকারী রেজিস্ট্রার (সার্জারি) ডাক্তার মারুফ হাসান অভি বলেন, অবশ্যই করোনা চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তা না হলে রাজধানীসহ দেশের সব বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে সংকট বাড়তেই থাকবে।