এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞে এগোচ্ছে নির্মাণকাজ

ডিসেম্বরে চালু হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে

হ কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত যান চলবে ডিসেম্বরে হ তিন চাকার কোনো বাহন চলবে না এক্সপ্রেসওয়েতে হ স্স্নাব বসানো, রড বাঁধা, ঢালাই এবং হাজারো শ্রমিকের হাঁক-ডাকে চলছে নির্মাণকাজ

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:১৬

আব্দুলস্নাহ রায়হান

রাজধানীর যানজট নিরসনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়াল সড়ক) কাজ দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-সংলগ্ন কাওলা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। তিন ধাপে কাজ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের। কাওলা থেকে বনানী অংশের প্রথম ধাপের কাজ প্রায় শেষ। চলছে দ্বিতীয় ধাপের কাজ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই তেজগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ করে ১১ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো উড়াল সড়কের কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটেই যাওয়া যাবে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত। ঢাকার ভেতরের যানজটে পড়তে হবে না কোনো যানবাহনকে। এতে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে। এই উড়াল সড়কটিতে যানবাহন চলবে উচ্চগতিতে, সেজন্য এখানে তিন চাকার বাহন চলতে দেওয়া হবে না। যানবাহনকে টোল দিয়ে উড়াল সড়ক ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগ ও এক্সপ্রেসওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। নানা কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়েছে কয়েকবার। তাই বর্তমানে রাত-দিন সমানতালে কাজ করছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ শ্রমিকরা। কাজের অগ্রগতিও ভালো। বনানী পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। এছাড়া বনানী থেকে তেজগাঁওয়ের অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। এই অংশের মূল কাজ শেষ। আগামী ১০ মাসের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আরও জানা গেছে, বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেতু বিভাগের। তবে, ঢাকার যানজটের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষ করে ১১ কিলোমিটার অংশ খুলে দিচ্ছে সরকার। বাকি ৮ দশমিক ২৩ কিলোমিটার খুলে দেওয়া হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই। এরফলে উড়াল সড়ক শুধু বিমানবন্দর ও যাত্রাবাড়ী রুটের যাত্রীদেরই স্বস্তি দেবে না, একইসঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে নিরসন হবে যানজট। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরপর সাত বছর কেটে গেলেও এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজে গতি পায়নি। ভূমি অধিগ্রহণ, অর্থের সংস্থানসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। তবে, অর্থের সংস্থান হওয়ার পর ২০২০ সালের জানুয়ারির দিকে কাজ শুরুর পর দ্রম্নতগতিতে এগিয়েছে পুরো প্রকল্পের কাজ। বুধবার সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এরইমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২৩৫টি ক্রস-বিম স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত যার পুরোটাই দৃশ্যমান। মহামারির মধ্যেও প্রকল্পের কাজ চলছে। বর্তমানে প্রকল্প ঘিরে কয়েক শিফটে হাজারো শ্রমিক কাজ করছে। কাওলা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটারের বেশি অংশে স্স্নাব বসানোর কাজ শেষ। একদিকে শ্রমিকরা দ্রম্নত হাতে রড বাঁধছেন ঢালাইয়ের জন্য। অন্যদিকে চলছে ঢালাই কাজ। শ্রমিকদের হাঁক-ডাকে প্রকল্প এলাকায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের মধ্যে ১ হাজার ৪৮২টি পাইলের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ৩২৯টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ২৯০, ৩২৯টি কলামের মধ্যে ২৮৫টি কলামের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৩২৯টি ক্রস-বিমের মধ্যে ২৩৫, ৩ হাজার ৭২টি আই গার্ডারের মধ্যে ১ হাজার ৪৫২টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন। এছাড়া বনানী থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ২ হাজার ১৭৯টি পাইলের মধ্যে ১২৫৩, ৬৩১টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ১২৫, ৬৩১টি কলামের মধ্যে ৯৯ ও তিনটি ক্রস-বিমের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রথমে মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পরে প্রকল্প ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পটির বিদ্যমান অংশের পরিমাণ ও ব্যয় বাড়ার কারণে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পে সংশোধনী এনে সময় ও ব্যয় আরও বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শতভাগ শেষ করার কথা জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত উড়াল সড়কে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। মূল উড়াল সড়কে ওঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র?্যাম্প থাকবে। র?্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। পিপিপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। যেখান থেকে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখছে পিপিপি। প্রকল্পের চুক্তি হওয়ার পর কাজ শুরু হতে সাত বছর দেরি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত আখতার জানান, প্রকল্প শুরুর পর এর সবচেয়ে বড় বাধা আসে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে। প্রকল্পের ২১০ একর জমির মধ্যে রেলের জমি ১২৮ একর, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৭ একর। সাধারণ মানুষের ২৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকি জমি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। তিনি বলেন, এসব জমি অধিগ্রহণ করে ঘর-বাড়ি স্থাপনা ভেঙে প্রকল্পের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে বেশি সময় চলে গেছে। এরপর দেখা দিয়েছিল প্রকল্পের অর্থ সংস্থানের জটিলতা। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো চীনা দুটি ব্যাংক থেকে ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের ২৭ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা (ভিজিএফ) দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে সাড়ে তেরশ ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাট বাজারদরের চেয়ে কমমূল্যে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হবে বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।