উপকূলে মানুষের দৈনিক খাবার জন্য যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন তা নেই। খাওয়ার পানির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন বৃহৎ আকারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। কিন্তু সেটাও নেই উপকূল অঞ্চলে। তাই খাওয়ার পানির অভাবে দিন কাটাচ্ছে উপকূলের কোটি মানুষ। মিঠা পানির অভাবে গৃহপালিত পশু লালন-পালনও ছেড়ে দিচ্ছেন উপকূলবাসী। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে সরকারি পর্যায়ে বৃহৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি তাদের।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন ইউনিয়নে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। এই এলাকায় এক সময় চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ত পানি আনা হয় সমুদ্র থেকে। সেই পানিই এখন এলাকার মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আর খাওয়ার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু পুকুর আছে যেখানে মিঠা পানি রয়েছে। সেখান থেকে মানুষ গিয়ে পানি কিনে আনে, তাও চড়া মূল্যে।
শ্যামনগর উপজেলায় ইউনিয়ন আছে ১২টি। এই ইউনিয়নগুলোতে সরকারি হিসেব মতে ৩ লাখ ১৮ হাজার ২৫৪ জন বসবাস করেন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। এই এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৭৫টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ৫৭০ জন। প্রাইমারি স্কুল রয়েছে ১৮৯টি ও মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে ৪৩টি। মাদ্রাসা আছে ৩৬ ও কলেজ ৭টি।
পানির সংকট নিরসনে নিজস্ব ব্যবস্থায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করছেন স্থানীয়রা। এর সঙ্গে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাও সহযোগিতা করছেন স্থানীয়দের। এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে সুপেয় পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন এনজিও। তাদের সহযোগিতায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যক্তি পর্যায়ে ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেলেও সরকারি পর্যায়ে তেমন হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের ত্রিপানি বিদ্যাপীঠে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় স্কুলটিতে ১০ হাজার লিটারের দুটি ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে। এই ট্যাঙ্কগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু এই পানি সংরক্ষণ করার পর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খাওয়ার উপযোগী করা হয়। এমন ৪২টি স্কুলে সাহায্য সংস্থা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
স্কুলটির নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়ন্ত মন্ডল বলেন, 'একটা সময় আমাদের পানি বাসা থেকে নিয়ে আসতে হতো। কারণ আমাদের এই চারপাশে কোনো সুপেয় পানি নেই। এমনকি আমাদের স্কুলের আশপাশে ওয়াশরুমে যাওয়ার পর লবণ পানি ব্যবহার করতে হতো। কিন্তু এই পানির ব্যবস্থা হওয়ার পর আমাদের আর সমস্যা হয় না। স্কুল খোলা থাকাকালীন আমরা এই পানি ব্যবহার করি।'
এ সময় কথা হয় অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহুয়া আক্তার, ইসরাত জাহান ও নওমি লিয়ার সঙ্গে। এই তিন শিক্ষার্থী তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, এতদূর থেকে খাবার পানি ও বিভিন্ন ব্যবহারের পানি নিয়ে আসাটা অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। বয়সন্ধিকালে বেশিরভাগ ছাত্রীরাই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু বৃষ্টির পানির এই ব্যবস্থা হওয়ার পর সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন আর শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা বন্ধ করেন না।
ত্রিপানি বিদ্যাপীঠের প্রধনা শিক্ষক আবুল কালাম মলিস্নক যায়যায়দিনকে বলেন, এই এলাকার প্রধান সমস্যা সুপেয় পানি ও ব্যবহার্য পানি। পানি সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভূগছে উপকূলের মানুষ। স্কুল-কলেজ তথা এই এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পানির জন্য। শিক্ষার্থী আসাও কমে যাচ্ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তবে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও সরকারের ছোট ছোট উদ্যোগে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, 'ওয়াটার এইড আমাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানে একটি ভালোমানের টয়লেট তৈরি করে দিয়েছে তারা। আর খাবার পানির জন্য একটি আলাদা স্থান তৈরি করে দিয়েছে। এখন আর বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হয় না। এখন স্কুল বন্ধ তাই আমাদের ধরে রাখা পানি ব্যবহার হচ্ছে কম। স্কুল খুলে গেলে যে পানি আমরা ধরে রাখব তাতে প্রতিষ্ঠানের সবার হয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকবে।'
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর মোহম্মদ ফজলুল হক বলেন, 'এলাকায় পানির খুবই অভাব চলছে। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ওয়াটার এইড বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিছু মানুষ উপকার পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানো সবার জন্য পানির ব্যবস্থা করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা বার বার উপজেলায় বলছি। আকাশের পানি ধরে আমরা খাচ্ছি। পানি ধরে রাখা তারপর সেটাকে খাওয়ার উপযোগী করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু সবার জন্য একই স্থানে এমন বড় কাজ করা সম্ভব না। তাই সরকারকেই বড় একটি প্রকল্প নিতে হবে। প্রয়োজনে আমি নিজের জমি সরকারকে দিয়ে দিব। তবুও আমাদের মিঠা পানির সমস্যা মিটুক।'
এদিকে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে ওয়াটার এইড। এই সংস্থাটি শ্যামনগর এলাকায় স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দিয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ সাধারণ মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসম্মত পানি ব্যবহার করতে পারে ও পান করতে পারে তা নিশ্চিত করা। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে মিলে তারা উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের সেবায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দিচ্ছে।
ওয়াটার এইডের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসিয়াল ইঞ্জিনিয়ার রেবিন চাকমা যায়যায়দিনকে বলেন, উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সবার আগে চিন্তা করতে হবে সরকারকেই। আর তাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া পানি। ব্যবহার্য ও সুপেয় পানি যতক্ষণ নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্ভব না। ওয়াটার এইড বাসায় বাসায় বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে সচেতন করছে কিন্তু এত বড় জনগোষ্ঠীকে মিঠা পানির আওতায় আনতে পারবে একমাত্র সরকার।
তিনি আরও বলেন, 'উপকূলবর্তী জনগোষ্ঠীর জন্য সেন্ট্রাল পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা থাকবে। সেখান থেকে পানি সরবরাহ করা হবে। এটি করতে দুটি বিষয় সামনে আসবে, অর্থায়ন ও জমি অধিগ্রহণ। দুটি বিষয় চাইলেই সরকার সমাধান করতে পারে। সরকার যদি চায় তাহলে এটা সম্ভব। কারণ তাদের লোকবল আছে। তবে বড় সমস্যা সদিচ্ছা। যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহেল মানুষকে সুপেয় পানি দেওয়া সম্ভব না। উপকূলীয় মানুষকে যদি আমরা পানির আওতায় আনতে চাই তাহলে অবশ্যই সেন্ট্রাল পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ওয়াটার এইড এডভোকেসি করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করছি ও সফলতা পেয়েছি। ব্যক্তি পর্যায়ে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং হচ্ছে। কিন্তু এত বড় জনগোষ্ঠীর জন্য আরও বড় আকারে কাজ করা দরকার। আরও বড় প্রকল্প নেওয়া দরকার। যা সরকার চাইলে যেকোনো সময় হতে পারে।'
রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের বিষয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেন খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুলস্নাহ। তিনি বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং খুবই জরুরি। এই অঞ্চলগুলোতে গভীর নলকূপ করে খাওয়ার যোগ পানি পাওয়া যায় না। তাই বৃষ্টির পানিই একমাত্র উৎস। তবে এটি করতে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। কত মানুষ ঐ এলাকায় বসবাস করে? কতটুকু পানি লাগবে প্রতি বছর? কত প্রতিষ্ঠান আছে? কতটুকু জায়গা লাগবে? কীভাবে পানি সরবরাহ হবে? ইত্যাদি।
তিনি আরও বলেন, এখানে দুটি প্রক্রিয়ায় হতে পারে। একটি ইউনিয়ন ভিত্তিতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং অপরটি সেন্ট্রাল রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং। প্রথমটি করতে খরচ কম হবে। কিন্তু সমস্যাও আছে। বড় ধরনের ঝড় আসলে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর সেন্ট্রাল রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং করতে বড় প্রকল্প নিতে হবে। বিশাল স্থান নিয়ে এটি হবে। এটা বড় দুর্যোগ আসলেও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা মাথায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
খুলনা ওয়াসার এমডি বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পানি সরবরাহ করা। এত বড় প্রকল্প তাদের দ্বারা সম্ভব কি না তা আগে দেখতে হবে। চাইলো লোকবল বৃদ্ধি করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। বড় প্রকল্প নিলে খরচ বেশি হবে তবে দীর্ঘদিন মানুষ এই প্রকল্পের সুফল ভোগ করবে।
সাতক্ষীরা জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চলে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের জন্য কোনো ধরনের সেন্ট্রাল প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এখানে মহলস্না বা পাড়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কিছু কিছু কাজ করেছে। এসব কাজ খুবই ছোট। ক্লাস্টার বেইজ এসব কাজ হয়েছে। কিন্তু পানি সংকট কাটাতে হবে অবশ্যই সমন্বিত মেগা প্রকল্প নিতে হবে। যা এখনো কেউ নেয়নি।
তিনি আরও বলেন, কোনো কাজই উপকূলের মানুষের জন্য হচ্ছে না। তাদের নিয়ে কোনো চিন্তাও নেই। সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে এভাবে লবণ পানি বাড়তে থাকলে। উপজেলায় মানুষ বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে একসময়। মিঠা পানির দ্রম্নত ব্যবস্থা করতে না পারলে এক সময় পরিত্যক্ত জমিতে পরণিত হবে উপকূলীয় অঞ্চল।
সাতক্ষীরা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহম্মদ আব্দুল বাছেক যায়যায়দিনকে বলেন, পানির সংকট সবচেয়ে বেশি হয় সাতক্ষীরার বেশ কয়েকটি উপজেলায়। এই এলাকায় পানির সমস্যা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের একেক দপ্তর একেক প্রকল্প করলে সমস্যা সমাধান সম্ভব না। পানির সমস্যা সমাধানে ওয়াটার এইড ও বিভিন্ন এনজিওসহ সরকারের সব দপ্তরকে একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, একটি পাড়া বা মহলস্নার জন্য পানি সমস্যা সমাধান করলে হবে না। একটি সেন্ট্রাল পানি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। বিশেষ করে মিঠা পানি সমস্যা সমাধান প্রয়োজন। তাই মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সিটি করপোরেশনগুলোর বাইরে মানুষের কাছে পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। এই দপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পরিকল্পনা তুষার মোহন সাধু খাঁ। উপকূল অঞ্চলে মিঠা পানির জন্য কোনো ধরনের সেন্ট্রাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন। বলেন, একটি মিটিংয়ে আছি। যদিও তিনি পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বে আছেন। তিনি এটিও স্বীকার করেন উপকূলের জনগোষ্ঠী মিঠা পানির সংকটে আছে।