কেনাকাটায় পুরনো রূপ আরও একটি মামলা
নিউমার্কেটে সংঘর্ষের মামলায় বিএনপি নেতা মকবুল গ্রেপ্তার
প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটের দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের মামলায় বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দপ্তর সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেছেন, শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা থেকে মকবুল হোসেনকে ধরে নিয়ে গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক বার্তায় মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়েছে। মকবুল হোসেন নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। গত সোমবার রাত ও মঙ্গলবার নিউমার্কেটের দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুইজনের প্রাণহানি এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এই সংঘর্ষের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে মকবুল হোসেনকে। নিউমার্কেট সূত্র বলছে, মার্কেটের ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের যে দুই দোকানের কর্মচারীদের বাগ্বিতন্ডা থেকে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়, সেই দোকান দুটি সিটি করপোরেশন থেকে মকবুলের নামে বরাদ্দ নেওয়া। তবে তিনি নিজে কোনো দোকানই চালাতেন না। মকবুলকে ধরে নেওয়ার কথা জানিয়ে বিএনপি নেতা সাইদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, 'মকবুল হোসেনকে যখন আটক করা হয় তখন তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে ছিলেন। গাড়ির চালককে নামিয়ে দিয়ে গাড়িসহ মকবুল হোসেনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গেছেন।' পুরনো রূপে নিউমার্কেট : চলছে ঈদের বাজার। নিজের ও প্রিয়জনদের জন্য পছন্দের জিনিস কিনতে দোকানে ভিড় ক্রেতাদের। সকাল থেকেই ক্রেতাদের সরব উপস্থিতি আর বিক্রেতাদের হাঁকডাক। সব মিলে সেই পুরনো রূপ ফিরে পেয়েছে রাজধানীর নিউমার্কেট। শুক্রবার সকালে নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকা ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়ে। এই মুহূর্তে ঈদের বাজার ধরতে মরিয়া ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ব্যাপক প্রস্তুতির কথা জানান তারা। নিউমার্কেট এলাকার ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও চাঁদনি চক শপিং কমপেস্নক্সের কাপড় ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় শাড়ি ও থ্রি-পিস। ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে তাঁতের রেশম ও সুতি শাড়ি, বেনারসি শাড়ি, রাজশাহী রেশমি শাড়ি, পাবনার শাড়ি, সিল্ক শাড়ি, মনিপুরী শাড়ি, কাতান শাড়ি, টাঙ্গাইলের সিল্ক শাড়িসহ সুতি শাড়ির পর্যাপ্ত মজুত রেখেছেন তারা। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের থ্রি-পিস, টু-পিস ও ওয়ান পিসের কালেকশনও রয়েছে। এছাড়াও পাঞ্জাবি, পায়জামা, ফতোয়া, বোরকা, হিজাব, ওড়না ও বাচ্চাদের কাপড় তো রয়েছেই। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের শাড়ি কাপড় ব্যবসায়ী আরিফুল হক বলেন, রমজানের শুরুতেই পাইকারি বাজারের চাহিদা থাকলেও এই মুহূর্তে খুচরা ক্রেতা বেশি আসছেন। এখানে সব ধরনের মানুষজন কেনাকাটা করতে আসেন। তাই দামের ক্ষেত্রেও সবার কথা চিন্তা করেই শাড়ি রাখা হয়েছে। সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা দামের শাড়ি আমার দোকানে রয়েছে। ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে মানুষের উপস্থিতি আরও বাড়বে। সকাল থেকেই চাঁদনি চক শপিং কমপেস্নক্স ও গাউছিয়া মার্কেটের সামনের অস্থায়ী দোকানগুলোতে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্রেতারা বলছেন, ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই এখানে আসছেন তারা। মিরপুর থেকে পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে আসা সুফিয়া বেগম বলেন, গ্রামের বাড়ি চলে যাব। আরও আগেই এখানে আসার চিন্তা ছিল। কিন্তু গত দুই দিন মার্কেট না খোলায় আসতে পারিনি। আমি প্রায় সময় নিউমার্কেট থেকেই কেনাকাটা করি। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে কম দামে জিনিস কিনতে পারি। যদিও এজন্য ভালো দামাদামি করতে হয়। মূলত শাড়ি, কাপড়, পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট, জুতা, কসমেটিকস, জুয়েলারি কিংবা গৃহস্থালিসহ নানা পণ্যের কেনাকাটার জন্য রাজধানীবাসীর অন্যতম পছন্দের স্থান নিউমার্কেট। বছরের সব সময়ই মানুষের ভিড় লেগেই থাকে এই এলাকায়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পূজাসহ অন্যান্য উৎসবকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মানুষের উপস্থিতি বাড়ে কয়েকগুণ। তবে গত দুই বছর করোনার বিধি-নিষেধের কারণে বেচাকেনায় সুবিধা করতে পারেননি এখানকার ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ সময় দোকান বন্ধ রাখায় অনেকে পুঁজিও হারিয়েছেন। সবমিলে এবারের ঈদকে সামনে রেখে ক্ষতি কাটিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যাশা জানিয়েছিলেন তারা। সেখানেও ঘটে ছন্দপতন। গত ১৯ ও ২০ এপ্রিল ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই দুই দিন মার্কেট বন্ধ থাকায় ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে- এমনটিই দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী রফিকুল আলম বলেন, ঈদ উপলক্ষে আমরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছি। সবাই পুঁজি সংগ্রহ করে ঈদ বাজার ধরতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। গত দুই দিনের অচলাবস্থার পর প্রত্যাশা করছি আজ থেকে আবারও আগের মতো ক্রেতাদের দেখা পাব। এদিকে নিউমার্কেট এলাকায় কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান নিউমার্কেট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাহেব আলী। তিনি বলেন, যে সমস্যা গত দুই দিন ছিল এখন তার কিছুই নেই। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুন্দর। ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারছেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। যেকোনো সমস্যায় আমরা সহযোগিতা করতে পারব। আরও একটি হত্যা মামলা : এদিকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় নিহত দোকানের কর্মচারী মুরসালিনের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের ভাই নূর মোহাম্মদ বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এই সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা দায়ের করা হলো। শুক্রবার নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ ম কাইয়ুম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মুরসালিন হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে একশ থেকে দেড়শ জনকে। এর আগে দায়ের করা তিন মামলায় ২৪ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাত নামা ১৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চারটি মামলার মধ্যে দুটি মামলা পুলিশ বাদী অন্য দুটি মামলা নিহত মুরসালিন ও নাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এর আগে নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন সরকারি সম্পদ জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আর নিউমার্কেট থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির বাদী হয়ে পুলিশের কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর করার অপরাধে ২৪ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাত নামা ৩০০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের অজ্ঞাতনামা ৭০০ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এছাড়া, সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত নাহিদের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাঈদ বাদী হয়ে ২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। দুই হত্যা মামলা যাচ্ছে ডিবিতে: রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় চারটি মামলার মধ্যে দুই হত্যা মামলার তদন্তভার পাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ডেলিভারিম্যান নাহিদ মিয়া নিহতের ঘটনায় বুধবার রাতে একটি হত্যা মামলা হয়। নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম জানান, নিহত নাহিদের চাচা মো. সাইদ যে হত্যা মামলাটি করেছেন, তা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'শুক্রবার ডকেটসহ সবকিছু গোয়েন্দা পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে।' আর দোকান কর্মচারী মোরসালিন নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে আরেকটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ মামলাতেও অজ্ঞাত পরিচয় ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নিউমার্কেট জোনের পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শাহেনশাহ বলেন, 'এই মামলাটিও গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।' বাকি দুই মামলার তদন্ত নিউমার্কেট থানা পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন ওসি কাইয়ুম। তিনি বলেন, 'পুলিশ সিসি ক্যামেরা ও অন্যান্য ভিডিও বিশ্লেষণ করছে।' নিউমার্কেটের চার নম্বর ফটকের ভেতরের সিসি ক্যামেরা ভিডিওতে ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পুলিশ সব কিছু নিয়ে কাজ করছে, হেলমেট পরা কারা ছিল আর বাইরে থেকে কে কে ওই এলাকায় গেছে, সেসব দেখা হচ্ছে।' হত্যা মামলার বাইরে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি মামলা করেছেন নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান। একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাওপোড়াও, পুলিশের কাজের বাধা দেওয়ার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন। পরিদর্শক ইয়ামিন কবিরের মামলায় নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনসহ ২৪ জনের নাম রয়েছে। মুরসালিন হত্যা মামলার প্রতিবেদন ৮ জুন : রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে দোকান কর্মচারী মুরসালিনের মৃতু্যর ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন। মুরসালিনের মৃতু্যর ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে তার ভাই নুর মোহাম্মদ হত্যা মামলা করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় মুরসালিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. মনিকা খন্দকার। ঢামেক হাসপাতাল মর্গ সূত্রে জানা যায়, আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুরসালিনের মৃতু্য হয়েছে। মুরসালিন কুমিলস্নার তিতাস উপজেলার বাডাকান্দি গ্রামের মো. মানিক মিয়ার ছেলে। বর্তমানে কামরাঙ্গীরচর ঝাউলাহাটি চৌরাস্তা এলাকায় থাকতেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মুরসালিন দ্বিতীয়। এছাড়া মুরসালিন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার স্ত্রীর নাম মিতু আক্তার। নিউমার্কেট থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) হালদার অর্পিত ঠাকুর জানান, মিরপুর রোডের নিউমার্কেটের সামনে মুরসালিন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলেন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃতু্য হয়।