গণটিকা কার্যক্রম

সনদ বিড়ম্বনায় ৩ কোটি মানুষ!

যারা 'সুরক্ষা' অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন তারা খুব দ্রম্নত ও ঝামেলা ছাড়াই টিকার সনদ বা সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা টিকা কার্ডের মাধ্যমে টিকা গ্রহণ করেছেন তারা পড়েছেন বিড়ম্বনায়

প্রকাশ | ১৭ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৭ মে ২০২২, ০৯:১৩

লাইজুল ইসলাম

দেশে করোনা টিকা প্রদানের জন্য দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। একটি অনলাইনে অপরটি গণটিকার আওতায় অফলাইনে কার্ডের মাধ্যমে। যারা অনলাইনে 'সুরক্ষা' অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন তারা খুব দ্রম্নত ও ঝামেলা ছাড়াই টিকার সনদ বা সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা টিকা কার্ডের মাধ্যমে টিকা গ্রহণ করেছেন তারা পড়েছেন বিড়ম্বনায়। বিশেষ করে স্কুল ও বিদেশগামীরা এই 'সনদ' বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এদিকে, গণটিকা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৩ কোটি মানুষ টিকা গ্রহণ করেন। তারা এখন সুরক্ষা অ্যাপে ঢুকে দেখেন করোনা টিকা গ্রহণের সনদ সেখানে নেই। এমন অনেকে আছেন যারা কর্মী হিসেবে নতুন করে বিদেশে যাচ্ছেন। তারা করোনা টিকার সনদ তুলতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এবার যারা হজে যাচ্ছেন তারাও বিপাকে পড়েছেন এই টিকার সনদ নিয়ে। এমনকি বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদেরও করোনা সনদ 'সুরক্ষা' অ্যাপে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিনের পর দিন ঘুরপাক খাচ্ছে টিকা 'সনদ' প্রার্থীরা। এই টিকা 'সনদ' বিড়ম্বনার শেষ কোথায় জানে না তারা। গেল কয়েকদিন ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে করোনা সনদের জন্য আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে সাধারণ মানুষের। কেউ নিজের সনদ, কেউ সন্তানের সনদ নেওয়ার জন্য এসেছেন অধিদপ্তরে। কয়েকদিন একটানা ঘুরেও কোনো সুরাহা করতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। এদিকে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা এই সমস্যা সমাধানে কী করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে 'সনদ' জটিলতার সমাধানে কাজ চলছে। অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গণটিকা গ্রহণকারীদের 'সুরক্ষা' অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করা নেই। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের নতুন করে অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আর তা না হলে তাদের পুরো তথ্য এই অ্যাপে ইনপুট দিতে হবে। এর পরই পাওয়া যাবে করোনার টিকা গ্রহণের সনদ। তবে এই কাজটি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ। এত লোকবলও অধিদপ্তরে নেই বলে জানিয়েছে সূত্রটি। সূত্রটি আরও জানায়, তারপরও যারা এই মুহূর্তে বিদেশে যেতে চাচ্ছেন তাদের দ্রম্নত সনদ দেওয়ার জন্য কাজ চলছে। কিন্তু সেটাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চতর পড়াশুনার জন্য বিদেশ যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিবারের সঙ্গে বিদেশ যাবে। তাদেরও করোনার টিকা গ্রহণ সনদ লাগবে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে কীভাবে কী করবে তার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না অধিদপ্তর। এদিকে, মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বড় জমায়েত হজ। এই হজ পালনে মক্কায় যাবেন বাংলাদেশের মুসলিস্নরা। মুসলিস্নদের মধ্যে যারা রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিয়েছেন তারা সহজেই সনদ পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা গণটিকার সময় টিকা গ্রহণ করেছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। এখন এই মুসলিস্নদের টিকা সনদ দেওয়ার কাজটি দ্রম্নত করে দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এমআইএস। আর বাকি যারা টিকা গ্রহণ করেছেন কার্ডের মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা অ্যাপেই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তারপর টিকা সনদ পাওয়া যাবে। তবে কবে নাগাদ এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে তা বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সূত্রটি। বরিশাল বাবুগঞ্জের বাসিন্দা মো. নুরে আলম। গণটিকা কার্যক্রমের সময় টিকা গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করেন ২৬ ফেব্রম্নয়ারি। এক মাস পর তিনি দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেন। কিন্তু সমস্যা হয় যখন তিনি চিকিৎসা করাতে বিদেশ যেতে চান। বিদেশ যাওয়ার জন্য টিকার সনদ বের করতে গিয়ে দেখেন সুরক্ষা অ্যাপে তার রেজিস্ট্রেশনই নেই। এই অবস্থায় তিনি ঢাকায় চলে আসেন। যোগাযোগ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগে। নুরে আলম বলেন, 'আমি গণটিকা গ্রহণ করেছি। এখনতো মনে হয় সমস্যায় পড়েছি। সে সময় টিকা নিয়েছিলাম বাড়িতে। এখন বিদেশ যাওয়ার জন্য বিদেশ যাব কিন্তু সনদ জটিলতায় আটকে গেছি। এখানে এসে যোগাযোগ করেছি। দেখি তারা কী করে। সনদ ছাড়া তো আর বিদেশে যেতে পারব না।' মগবাজারের টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাসিন্দা আফছানা আজাদেরও একই সমস্যা। তিনি স্কুল থেকে টিকা গ্রহণ করলেও নেই কোনো রেজিস্ট্রেশন। এখন পরিবারের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যেতে চাইলেও পাচ্ছেন না টিকা সনদ। এই অবস্থায় তার বাবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন। আফছানা আজাদের বাবা বলেন, 'বেশ কয়েকদিন আগে এসেছিলাম। সেসময় জেনেছি কি কি কাগজ লাগবে। তা নিয়ে আবার এসেছি। এরপর একটি এসএমএস পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে। এখন আবার ২৮ দিন পর সনদ নিতে এখানে আসতে হয়েছে। এটা বিরাট একটা ঝামেলা।' এ সময় আফসানা আজাদ বলেন, 'আমরা তো সব কিছু স্কুলে জমা দিয়ে টিকা নিয়েছি। কিন্তু তারা কেনো রেজিস্ট্রেশন করেননি, তা আমরা বলতে পারব না। কিন্তু এই সমস্যায় পরে এখানে বেশ কয়েকদিন আসতে হয়েছে। এটা বড় ধরনের বিড়ম্বনা।' এ সময় আরেক ভুক্তভোগী বলেন, 'টিকা দেওয়ার সময় আমি সঠিক ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। সেটা তাদের কর্মীরা ভুল করেছে। এখন এই ভুলের মাশুল আমাকে দিতে হচ্ছে। টিকার সনদ নিয়ে জটিলাতা সৃষ্টি হয়েছে। আমি এই সমস্যা সমাধানে এসেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১২ কোটি ৮৬ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫ জন মানুষ। যার মধ্যে ৯ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার ১৭১ বেশি অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিয়েছেন। এদের মধ্যে সুরক্ষা অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ৯ কোটি ৮ লাখ ১ হাজার ৮২৩ জন। পাসপোর্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৮৮ জন ও জন্মসনদ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ৬৯ লাখ ৬২ হাজার ৬০ জন। মোট নিবন্ধন ৯ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ জন। বাকি ২ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৭৪ জন গণটিকার আওতায় কার্ডের মাধ্যমে টিকা নিয়েছেন। এর সবাই বর্তমানে সনদ পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় আছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ও লাইন ডাইরেক্টর এইচআইএস অ্যান্ড ই-হেলথের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'প্রায় তিন কোটি মানুষ কার্ডের মাধ্যমে টিকা গ্রহণ করেছেন। তাদের টিকা সনদ দেওয়ার কাজ চলছে। তবে এদের মধ্যে যারা হজে যাবেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা সনদ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া যারা অধিদপ্তরে আসছেন তাদের সনদ দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। আর যাদের ভুল আছে সনদে তাও আমরা ঠিক করে দিচ্ছি। যাই করতে চান যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমেই করতে হবে।' প্রায় তিন কোটি মানুষ অ্যাপ থেকে কীভাবে সনদ পাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এই তিন কোটি মানুষের সবার কিন্তু টিকা সনদ লাগছে না। এদের ভেতরে কিছু মানুষের টিকা সনদ লাগছে। বাকিরা কিন্তু দেশের ভেতরেই থাকছেন। যারা দেশের ভেতরে থাকবেন তাদের টিকা কার্ড দিয়েই চলবে। টিকা সনদের দরকার নেই। তবে যারা বাইরে যাবে তাদের অবশ্যই টিকা সনদ নিতে হবে। সেজন্য অ্যাপ নিয়ে আমরা কাজ করছি। রেজিস্ট্রেশনটা আমরা আরও সহজতর করার চেষ্টা করছি। যাতে করে এই মানুষগুলো রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এসে টিকা সনদ পেতে পারে।' তিনি আরও বলেন, 'টিকা সনদ পেতে হলে অবশ্যই পাসপোর্ট, জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র এই তিনটির একটি থাকতেই হবে। তা না হলে কোনোভাবেই সনদ বের করা যাবে না। অ্যাপে আমরা এমন সিসটেম করে দিয়েছি যাতে কোনো সমস্যা ছাড়াই টিকা গ্রহণ করা ব্যক্তিরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। এরপর বাসার কাছাকাছি যেকোনো কেন্দ্রে গিয়ে টিকা গ্রহণের কার্ড দেখালেই ওটা ইনপুট করে দিবে সংশ্লিষ্টরা। ইনপুট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকা সনদ পাওয়া যাবে।'