সিলেটে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা

তলিয়ে যাচ্ছে শহরের সড়ক জৈন্তাপুরে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি ভেসে গেছে মৎস্যচাষিদের স্বপ্ন তাহিরপুরে পাঠদান বন্ধ অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়ে

প্রকাশ | ১৮ মে ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি ডেস্ক
সিলেটে বেড়েই চলেছে বন্যার পানি। সুরমা নদীর তীর উপচে পানি প্রবেশ করেছে সিলেট শহরেও। বন্যার পানি থেকে বাঁচতে গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে মানুষ। ছবিটি সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি
অব্যাহত ভারী বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। পানি শহরে ঢুকে সড়ক ও বাড়িঘরের আঙিনা ডুবে যাচ্ছে। বিশেষ করে জৈন্তাপুর উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে হাজারো মৎস্যচাষির স্বপ্ন। নষ্ট হচ্ছে আমন ধানের বীজতলা ও বিভিন্ন সবজি ফসল। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে নদী তীরবর্তী অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আঙিনা ও ভবনের ভেতর পানি ঢুকে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ। আকস্মিক এ বন্যায় চরম বিপাকে পড়েছে মানুষ। সমস্যা বিবেচনায় এখনো নেওয়া হয়নি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি। আমাদের অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : সিলেট : সুরমার কিছু নিচু তীর এলাকা উপচে পানি সিলেট শহরে ঢুকে পড়েছে। সড়কগুলো তলিয়ে যাচ্ছে, বাড়িঘরে প্রবেশ করছে পানি। এতে বন্যা পরিস্থিতি যেকোনো সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। মঙ্গলবার সিলেট নগরী ও শহরের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা যায়। জলাবদ্ধতা সৃষ্ট এলাকাগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে নগরের শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, সোবহানিঘাট, কালীঘাট, শেখঘাট, তালতলা, পাঠানটুলা, লন্ডনি রোড, সাগরদীঘির পাড়, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, মদিনা মার্কেট, দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোড, ভার্তখলা, মোমিনখলা, পিরোজপুর, আলমপুর ও ঝালোপাড়া এলাকা। বিপৎসীমা অতিক্রম করা ভরা সুরমার পানিতে নগরের ছড়াখাল ভরে গিয়ে রাস্তাঘাট ডুবছে। অনেকের বাসা-বাড়িতে নিচের ফ্লোরে পানি চলে গেলে। যত সময় যাচ্ছে, ততই জোয়ারের ন্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি। আর টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাবে সিলেট নগরী। সোমবার দিনেও বিভিন্ন সড়ক ও গলিতে পানি মাড়িয়েছে। পানি ঢুকেছে বাসা-বাড়ি, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আগামী ২৪ ঘণ্টা এ অবস্থা চলতে থাকলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে মনে করছেন নগরের বাসিন্দারা। অনেকে বাসা-বাড়িতে পানি ওঠার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ছেন। যেসব রাস্তা-ঘাটে বিগত দিনে বন্যায়ও পানির দেখা পায়নি সেসবে হাঁটু থেকে কোমর পানি জমেছে। বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়ি ও দোকানপাটে পানি উঠে চড়ম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। নগরের মাছিমপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম সামি বলেন, দিনের বেলা সড়কে জলাবদ্ধতা মাড়িয়ে চলতে হয়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে পানি ঢোকার কারণে অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ছড়ারপাড়ের বাসিন্দা আরাফাত হোসেন সিয়াম বলেন, ছড়ার পানি চালিবন্দর-ছড়ারপাড় সড়কে উঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন কলোনিতে এরইমধ্যে পানি উঠে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সুরমা-কুশিয়ারা, লোভা, সারি ও দলাই নদীর পানি ৭টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জৈন্তাপুর (সিলেট) : উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সারী, করিচ, কাপনা ও বড়গাং নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার ৬ ইউনিয়নে বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়েছে মানুষের ঘর-বাড়ি। ভেসে গেছে হাজারো মৎস্যচাষির স্বপ্ন। এছাড়া নদী ও পাহাড়ি ছড়ায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি পস্নাবিত হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে অনেকেই। বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করায় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানিতে ভেজা বোরো ধানে চারা গজিয়েছে। এ ছাড়া আমন ধানের বীজতলা, বিভিন্ন সবজি ফসল ও শতাধিক মৎস্য খামার পানিতে তলিয়ে গেছে। গত ১১ মে থেকে জৈন্তাপুর উপজেলায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা শুরু হয়। বিগত দিনে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ১৫ মে গভীর রাত থেকে নদীগুলোর পানি পুনরায় বৃদ্ধি পায়। সোমবার ভোর থেকে সারী নদীর পানি বিপৎসীমার .৪৪ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মঙ্গরবার সারী নদীর পানি বিপৎসীমার .১৮ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে করিচ ও কাপনা নদীর পানি অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। গৃহপালিত পশুপাখি নিয়েও তারা পড়েছে মহাবিপদে। বন্যায় কারও ঘরে পানি, কার দুয়ারে। বন্যায় কবলিত এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু স্থানে ও অন্যের বাড়িতে। কেউ টং পেতে পরিবার নিয়ে নানা কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। অনেকের রাত দিন কাটাতে হচ্ছে নৌকায়। পানি কমার অপেক্ষায় বন্যায় কবলিত মানুষ। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর কষ্টের শেষ নেই। তিন বেলা খেতেও পারছেন না অনেকেই। সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের মেঘলী, বন্দরহাটি, লামাপাড়া, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, মজুমদার পাড়া, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, তিলকৈপাড়া, বড়খেল, ফুলবাড়ী, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, হেলিরাই এবং জৈন্তাপুর ইউনিয়নের মুক্তাপুর, বিরাইমারা, বিরাইমারা হাওড়, লামনীগ্রাম, কাটাখাল, খারুবিল, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নং লক্ষ্ণীপুর, ২নং লক্ষ্ণীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, নলজুরী হাওড় বন্যাকবলিত এলাকা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ৩নং চারিকাটা ইউনিয়নের বালিদাঁড়া, লালাখাল, রামপ্রসাদ, থুবাং, বাউরভাগ উত্তর, বাউরভাগ দক্ষিণ, পুঞ্জী ৫নং ফতেপুর ইউনিয়নের হেমু ভাটপাড়া, মাঝপাড়া, দত্তপাড়া, বালিপাড়া, নয়াগ্রাম, নয়াগ্রাম দক্ষিণ, ভেলোপাড়া এবং ৬নং চিকনাগুল ইউনিয়নের কান্দী ৪নং দরবস্ত ইউনিয়নের মহাইল, মুটগুঞ্জা, সেনগ্রাম, গর্দনা, ফরফরা, শুকইনপুর, রনিফৌদ, সাতারখাইসহ ছয়টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। তাদের চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। বন্যায় কবলিত যারা দিনমজুর তাদের কষ্টের শেষ নেই। তিন বেলা তিন মুঠো খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওইসব পরিবারের। অনেকেই রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বন্যায় পস্নাবিত হওয়া এলাকার শিশু-কিশোরদের নিয়েও অনেক কষ্টে রয়েছে তাদের পরিবার। সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না বন্যায় কবলিত অনেক এলাকার মানুষ। চিকিৎসাসেবা থেকেও তারা রয়েছে বঞ্চিত। হেমু ভাটপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্বাস উদ্দিন বলেন, মানুষ মাচা, টং ও নৌকায় দিন কাটাচ্ছে। এতে রান্না-বান্নাসহ নানা সমস্যায় চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। বৃষ্টি এলে পানিতে ভিজতে হয়। গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে ও রয়েছে তারা মহাবিপদে। উপজেলা কৃষি অফিসার সূত্রে জানা যায়, জৈন্তাপুর উপজেলায় এবারের বন্যায় এ পর্যন্ত ৪০ একর হালিতলা পানির নিচে নিমজ্জিত এবং প্রায় ১০০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এ. কে. এম নিলয় পাশা বলেন, সারী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ে বৃষ্টি থেমে গেলে পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতিপূর্বে পানিবন্দি মানুষের মাঝে ত্রাণ ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। একই সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেটও বিতরণ করা হচ্ছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষের সহায়তায় সার্বক্ষণিক কাজ করতে প্রস্তুত আছি। তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : উপজেলার যাদুকাটা, রক্তি ও বৌলাই নদী তীরবর্তী অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আঙিনা ও ভবনের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। এছাড়া তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার সকালে পানিবন্দি এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা উপস্থিত হলেও এমন পরিস্থিতিতে কোনো পাঠদান হয়নি। বালিজুরী নয়াহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক এনামুল হক জানান, বিদ্যালয় ভবনের ভেতর পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। কিন্তু কোনো পাঠদান করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে পানিবন্দি রয়েছে বালিুজুরী নয়াহাটি, বালিজুরী, মেঞ্জারগাও, বড়খলা, নোয়াহাট, মাহতাবপুর, দক্ষিণকুল, লক্ষ্ণীপুর, জামালগড়, রসুলপুর, ইসলামপুর, পাতারগাও, সোনাপুর, হোসেনপুরসহ অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইসলামপুর সরকারি পাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষিক রোমানা আক্তার রোনিয়া জানান, বিদ্যালয় আঙিনায় পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করায় আজ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম। অপরদিকে তাহিরপুর সুনামগঞ্জ সড়কে আনোয়পুর ব্রিজের পূর্ব পাশে সড়কের উপর দিয়ে সোমবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে তাহিরপুর বাদাঘাট সড়কে হোস্নার ঘাট থেকে পাতারগাও পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় তাহিরপুর বাদাঘাট সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাইদ বলেন, বন্যার বিষয়টি তিনি জেনেছেন। যেসব বিদ্যালয়ের আঙিনা ও ভবনের ভেতর পানি ঢুকেছে সেসব প্রতিষ্ঠানে মঙ্গলবার ক্লাস হয়নি। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রায়হান কবির বলেন, তাহিরপুরে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক খোঁজখবর রাখছি।