বন্যা পরিস্থিতি :সিলেট নগরীতে উন্নতি, নিম্নাঞ্চলে অবনতি

অনাহারে-অর্ধাহারে বানভাসি মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২২, ০০:০০

ম বিশেষ প্রতিনিধি
বন্যাকবলিত সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগরে বালিয়াকান্দি গ্রামের দুই শিশু যাতায়াত করছে ভেলা দিয়ে -স্টার মেইল
সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শহর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় নতুন করে পস্নাবিত হচ্ছে জেলার নিম্নাঞ্চল। কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি হু-হু করে ঢুকছে। এতে করে বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। সিলেটের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও ফেঞ্চুগঞ্জ এই ছয় উপজেলার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনাহারে-অর্ধাহারে বানভাসি মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ত্রাণ বিতরণের খবর পেলেই ছুটে আসছেন বন্যাকবলিত মানুষ। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ কম হওয়ায় অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। রোববার সকাল থেকে সিলেট নগরে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। দুর্ভোগ বাড়ছে, এখনো নিচু এলাকার সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে আছে। পানি নামতে শুরু হলেও এখনো বেশকিছু এলাকা জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দা পড়েছেন সমস্যার মধ্যে। পানি কমতে থাকায় বাসাবাড়ি থেকে ময়লা ও পচাপানির দুর্গন্ধে অস্থির জনজীবন। অনেকে ঘরের মালামাল গোছানো, জমে থাকা ময়লা ও পানি নিষ্কাশনের কাজ করছেন। নগরবাসী বাড়িঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নগরের শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, তালতলা, জামতলা, মণিপুরি রাজবাড়ী এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। প্রধান সড়কগুলোয় পানি কমে গেলেও পাড়া-মহলস্নার ভেতরে এখনো রয়ে গেছে বন্যার পানি। জমে থাকা পানিগুলো কয়েক দিন একই স্থানে থাকায় কালো রং ধারণ করেছে। সেগুলো থেকে বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ। গত মঙ্গলবার থেকে সিলেট নগরের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে দুর্ভোগের \হশিকার হতে হয়েছে বাসিন্দাদের। অনেকে বাসাবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়স্বজন ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি কমতে শুরু করেছে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুরসহ বন্যাকবলিত ৯টি উপজেলায়। তবে জেলার ভাটি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার ও পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। জেলার সীমান্তবর্তী পাঁচটি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি বেড়েছে শান্তিগঞ্জ, দিরাই, শালস্না ও জগন্নাথপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে। জগন্নাথপুর এলাকার চিলাউড়া-হলদিপুর, রানীগঞ্জ ও পাইলগাঁও এই ৩টি ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেছে। বন্যায় দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুর উপজেলার ৩টি সেতু ভেসে গেছে। জেলায় ১৯৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা শহরের সুনামগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ছাতক উপজেলার কৈতক ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের নিচতলায় পানি ওঠায় রোগী ও চিকিৎসকরা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫০০ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকা। ৭৭৭ হেক্টর জমির পাকা বোরো ধান, ৭৫ হেক্টর জমির বাদাম, আউশ বীজতলা ৭৪ হেক্টর, সবজি ৬০ হেক্টর ও ২০ হেক্টর আউশ ধান ডুবে গেছে। সিলেট অফিস জানায়, সিলেট নগরীর পানি কমলেও বন্যার পানি অন্য এলাকা পস্নাবিত করছে। সুরমা নদীর পানি কমলেও কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি হুহু করে ঢুকছে। এতে বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও ফেঞ্চুগঞ্জ এ ৬টি উপজেলার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবারের পাশাপাশি রয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। অনাহারে, অর্ধাহারে রয়েছে বানভাসি মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সিলেটে নতুন করে কুশিয়ারা নদীতে পানি বেড়েছে। কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় পানি ইতোমধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া কানাইঘাটে সুরমা, জকিগঞ্জে অমলসীদ, বিয়ানীবাজারে শ্যাওলা ও সিলেটের সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কেএম নীলয় পাশা বলেন, বিভিন্ন স্থানে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে। এতে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। অমলসীদে বাঁধ কেটে দেওয়ার কারণে পানি ঢুকছে। অন্তত ২০ গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সিলেটের জকিগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলররা জানান, অনেক স্থানে কুশিয়ারার বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। সিলেটের আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, আগামী দু-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত কমে যাবে। এদিকে, সিলেট নগরে পানি কমছে। তবে এখনো নগরীর উপশহর, ঘাষিটুলা, বেতরবাজার, কানিশাইল, মাছিমপুর, বাণিজ্যিক এলাকা কালীঘাট, সুবহানীঘাট, যতরপুরসহ কয়েকটি স্থানে হাঁটু পরিমাণ পানি রয়েছে। কিছু স্থানে পানি নেমে যাওয়ায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠছে। কালিঘাটের চাল ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা জানান, বন্যায় অন্তত তাদের ২০ কোটি টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। গোটা কালীঘাটই ছিল পানি নিচে। এ কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে যাওয়ায় তারা মালামাল সরাতেও পারেননি। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে যারা আছেন তাদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যায় যাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয় সেজন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। বন্যার কারণে সিলেট নগরীর ৬ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৭৪টিতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বন্যাদুর্গতদের পাশে রয়েছে। ত্রাণসহ বন্যাপরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হবে। সিলেটের সিভিল সার্জন ডা এস এম শাহারিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে শতাধিক লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছি। চর্মরোগও বাড়ছে। পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এজন্য আমরা এরই মধ্যে ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করেছি। তারা বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্তদের সেবায় কাজ করছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, শনিবার পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে ৩২৫ টন চাল, ১৫ লাখ টাকা ও সাড়ে ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এখনও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেওয়া হবে। নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডস্থ গালিমপুর বাজারে হাঁটুপানি, মাধবপুর-গালিমপুর গ্রামের সিংহভাগ বাড়িঘরে পানি উঠেছে। কুশিয়ারা ডাইক ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেলে ডাইক উপচে পানি প্রবেশ করতে পারে। এতে নবীগঞ্জের বেশ কয়েক'টি ইউনিয়নে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এই খবর পেয়ে শনিবার রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মহি উদ্দিন। ইউএনও পরামর্শে পানি উন্নয়ন বোর্ড রোববার সকালে বাঁধে কাজ করার জন্য খালি বস্তা পাঠিয়েছে। স্থানীয় লোকজন বস্তায় বালি ও মাটি ভর্তি করে বাঁধ মেরামত শুরু করেছেন। শনিবার রাত থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। স্থানীয়রা জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে অতিবাহিত করছে। ফলে নদীর তীরবর্তী মথুরাপুর, আহমদপুর, জামারগাঁও পয়েন্ট, গালিমপুর ও মাধবপুর এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। মাধবপুর-গালিমপুর এলাকায় শতকারা ৮০ ভাগ মানুষের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড মেম্বার আকুল মিয়া। স্থানীয় মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।