দেশি ফলেই বেশি বিষ!

সারাদেশে ফলের বাজার ও আড়তে আমসহ কোনো ফল পাকাতে ও সংরক্ষণে যাতে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করতে না পারে তা তদারকির জন্য ২০১৯ সালের ২০ মে মনিটরিং টিম গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ মে ২০২২, ০৯:১২

সাখাওয়াত হোসেন

দেশের যেকোনো এলাকার বাগান কিংবা ক্ষেত থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে তা ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা। পরিপক্ব যেকোনো ফলেই এ স্বল্প সময়ে পচন ধরে না। অথচ পচন থেকে রক্ষার অজুহাতেই আম, জাম, লিচু, কলা থেকে শুরু করে সব ধরনের মৌসুমি ফলমূলেই নানা বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবদেহে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সি মানুষ লিভার, কিডনি রোগ, এমনকি ক্যানসারের মতো ভয়াবহ নানা মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল ফলমূল খেয়ে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এছাড়া গর্ভবতীদের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ভয়ংকর এ পরিস্থিতিতে কয়েক বছর আগেই ফল পাকানো ও সংরক্ষণে রাসায়নিকের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। ২০১৯ সালের ২০ মে হাইকোর্টের এক আদেশে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিষাক্ত ফল যেন কেউ গুদামজাত ও বিক্রি করতে না পারে তা সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য বিএসটিআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অথচ এ নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে ফলের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিষ প্রয়োগ চলছেই। আর এসব ফলমূল খেয়ে লিভার-কিডনিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ফল পাকানো ও দ্রম্নত পচন রোধে ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক এবং গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে প্রতিবছর কত মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও তা ২০ লাখের কম নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ফরমালডিহাইড চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে রেটিনার কোষ ধ্বংস করে। ফলে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। ফলমূলে প্রয়োগকৃত বিভিন্ন রাসায়নিক ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যানসার ছড়াচ্ছে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি বস্নাড ক্যানসারেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকদের ভাষ্য, মানবদেহে ফরমালিন ফরমালডিহাইড ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সব বয়সি মানুষের জন্যই এসব রাসায়নিক ঝুঁকিপূর্ণ হলেও শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুর শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। তাদের বুদ্ধিমত্তা দিনে দিনে কমছে। গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হচ্ছে। তবে এসবের বেশিরভাগ সমস্যা ধীরে ধীরে দেখা দেওয়ায় তা ভুক্তভোগীদের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, বিদেশ থেকে আসা আপেল, নাশপতি ও আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফলমূলে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রয়োগ করা হলেও তা অনেকটা পরিমিত। তবে দেশীয় ফলমূলে তা মাত্রাতিরিক্ত হারে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এদিকে ফলের মৌসুমের শুরুতেই গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর সবখানের হাট-বাজার ও দোকানে পাকা আম, জাম, লিচু, কাঁঠালের সরবরাহ বাড়তে শুরু করলেও এসব ফলমূল কতটা বিষমুক্ত তা নজরদারিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি আগের মতোই খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের বাজারে যে পাকা আম বিক্রি করা হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই রাসায়নিক বিষে ভরা। ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে দিয়ে এসব আম হলুদ বর্ণে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যা ফরমালিনের চেয়েও ভয়ংকর। অপরিপক্ব কাঁঠাল পাকাতে বিষ মেশানো লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৌসুমি আরেক দেশি ফল লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ঝরে না পড়া, বোটা শক্ত রাখা, রঙ চকচকে করার জন্য কৃষকরা জেনে বুঝেই এতে মাত্রাতিরিক্ত বিষ ছিটাচ্ছে। লিচু বাগানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুটি অবস্থায় লিচুর বাগান কিনে নিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রথমে ফল গঠনে সহায়তা করার জন্য গোটা গাছে জৈব উজ্জীবক ট্রায়াকন্টানল, ম্যানকোজেব ছিটান। এরপর ছত্রাকনাশক ল্যাম্বডা সাইহ্যালেথ্রিন প্রয়োগ করার পর ফল কিছুটা বড় হলে নিয়মিত বিরতিতে কার্বেন্ডাজিম ও সাইফারমেথ্রিন নামের কীটনাশক ছিটানো হয়। লিচু রসাল হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে ম্যানকোজেব, ট্রায়াকন্টানল, বোরন ও হরমোনজাতীয় নানা ওষুধ স্প্রে করেন। এতে লিচু দ্রম্নত পাকে ও রং টকটকে লাল হয়। এ বিষযুক্ত ফলের তালিকার অগ্রভাগে রয়েছে বিভিন্ন জাতের কলা। সবরি-চাঁপা-সাগরসহ সব কলাতেই সময়ের আগে হরমোন স্প্রে করা হচ্ছে। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন-ইথোফেন বা কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। এর আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা যেকোনো গুঁড়া সাবান দিয়ে। পাকানোর এই বিষাক্ত পদ্ধতি রাজধানীর বাদামতলী থেকে কাওরান বাজার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি কলার আড়তেই হরদম চলছে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল খেলে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডিন, দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুলস্নাহ। তিনি বলেন, কার্বাইডের ফলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া অতিরিক্ত কার্বাইড মেশানো ফল খেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে যকৃৎ ও কিডনির ক্ষতি হতে পারে। প্রিভেন্টিভ মেডিসিন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে 'কার্বাইড দিয়ে ফল পাকালে যেসব সমস্যা হয়, তার মধ্যে প্রথমত আমাদের পেটের ভেতরে হজম করার যে প্রক্রিয়া থাকে, সেটির বিঘ্ন ঘটে। ফলে পেটে ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া হতে পারে। কারও কারও বুক জ্বালাও করে। এর বাইরে কার্বাইড যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, এটা ধীরে ধীরে রক্তের মাধ্যমে লিভার ও কিডনিতে ঢুকে যায়। এর কারণে লিভার ও কিডনির কাজ করার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া কার্বাইডের কারণে অনেকের শরীর ঝিমঝিম করে ও মাথা ঘোরে। কার্বাইড কারও কারও শরীরে এলার্জি তৈরি করে। যার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট ও হাতে পায়ে চুলকানি দেখা দেয়। মোট কথা কার্বাইড দিয়ে আম পাকালে আমের ভেতরে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ যে পুষ্টিগুণ থাকে তা নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি কার্বাইড শরীরের ভিতরে ক্ষতি করে।' প্রসঙ্গত, ঢাকাসহ সারাদেশে ফলের বাজার ও আড়তে আমসহ কোনো ফল পাকাতে ও সংরক্ষণে যাতে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করতে না পারে তা তদারকির জন্য ২০১৯ সালের ২০ মে মনিটরিং টিম গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক আবেদনে এ আদেশ দেন আদালত। তবে উচ্চ আদালতের এ নিদের্শনার পর কিছু দিন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও তা ধীরে ধীরে নাজুক হয়ে পড়ে।