স্বাভাবিক সরবরাহেও দেশে অস্থিতিশীল চালের বাজার

নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু পরিকল্পনার বড় ঘাটতি হ নেই অটো রাইস মিলারদের লাগাম টানার কৌশল হ প্রচলিত মজুতদারি আইনে অনেক বড় ফাঁক

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ মে ২০২২, ০৯:২০

সাখাওয়াত হোসেন

আমনের বাম্পার ফলন, সরকারি গুদামে রেকর্ড মজুত এবং সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক হ্রাসসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও সরকার বাজারে চালের দামে লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম অস্থিতিশীল। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুত ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবে চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের হাতেই থাকে বেশিরভাগ ধান-চালের মজুত। তারা প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। কয়টা অটো রাইস মিল চলার মতো ধান দেশে আছে, এসব মিলের উৎপাদন সক্ষমতা কতটুকু হবে- এসব বিষয় নির্ধারণ না করেই মজুত আইন তৈরি করা হয়েছে। এ সুযোগে অটো রাইস মিলাররা সিন্ডিকেট করে স্বাভাবিক সরবরাহ পরিস্থিতিতেও বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ পাচ্ছে। তাই সরকারের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণের কলকাঠি ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে মজুত আইন সংশোধন করা জরুরি বলে মনে করেন তারা। খাদ্য খাত পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, চালের দাম নির্ধারণ ও বিপণনের স্টিয়ারিং মিলারদের হাতে। কেননা বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের অবস্থাও বেশ নাজুক। তাই সক্ষমতার পাশাপাশি চালের সরবরাহ চেইনে আরও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে কৃষকের মজুত ক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহের ওপরও জোর দিতে হবে। সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা ও দুর্বলতা দূর করার তাগিদ দিয়ে তারা বলেন, ধানের এত বড় বাজার এককভাবে ব্যবসায়ী ও মিলারদের হাতে চলে যাওয়ার কারণেই প্রায়ই এ পণ্যের বাজার মাঝেমধ্যেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সরবরাহ চেইনের সমস্যাগুলো দূর করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব দূর হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অযৌক্তিক আচরণ করতে পারবে না। এজন্য সরকারের মজুত সক্ষমতা বাড়ানো, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রচলন করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের স্টিয়ারিং সরকারের হাতে রাখতে হলে খাদ্য অধিদপ্তরকে দেশে মোট উৎপাদিত চালের নূ্যনতম ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে বলে মনে করেন তারা। তবে বিশ্ব বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী অনেকের আশঙ্কা, শুধু স্থানীয় উৎপাদনের ওপর ভরসা করে সামনের দিনগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। এ পরিস্থিতিতে চাল আমদানির আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি দাবি করে তারা বলেন, দেশে বোরো উৎপাদন ভালো হলেও, সামনের দিনগুলোতে চালের চাহিদা অনেক বাড়বে। কারণ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেশি হওয়ায়, মানুষ বিকল্প খাদ্যের চেয়ে ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াবে। এ অবস্থায় আগামীতে চালের দাম আরও অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মে পর্যন্ত সরকারের কাছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজার টন গম এবং ১০ লাখ ১৫ হাজার টন ধান-চাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত ১০ লাখ টনের নিচে গেলে তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দাম বাড়তে শুরু করে। তাই এ ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি রাখা জরুরি। সরকার স্থানীয় বাজার থেকে ১৮ লাখ টন বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল এবং ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নেবে। তবে ততক্ষণে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যাবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, বোরোর বাম্পার ফলন কয়েক মাসের জন্য আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও, খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। ইতোমধ্যে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের বাজারে গমের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল এবং খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এ অবস্থায় তারা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের জন্য খুব বেশি অর্থ ব্যয় করবে না। সুতরাং, সামনের দিনগুলোতে ধান-চালের ওপরই মূল চাপ পড়বে। আগামীতে ভারতের মতো চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকেও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাই সাপস্নাই চেইন শক্তিশালী রাখতে এসব বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। বিশ্ব বাজারে খাদ্য পণ্যের দামের ব্যাপক ওঠানামার কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় উৎস ব্যবহার করে দেশের চাহিদা অনুযায়ী সরকারের খাদ্যের মজুত রাখা জরুরি বলে মনে করেন তারা। এদিকে চালের স্বাভাবিক সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও বাজার অস্থিতিশীল থাকার কথা খোদ ব্যবসায়ী নেতারাও স্বীকার করেছেন। তবে এজন্য তারা অটো রাইস মিলার এবং অবৈধ মজুতদারদের পাশাপাশি সরকারের পরিকল্পনায় বড় ঘাটতিকে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কৌশলী ছক না এঁটে ভোক্তা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে গোটা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলে। যা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সময় সময়ে দাম সমন্বয় করা হলে সয়াবিন তেলের সংকট ও বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতো না। এর উপর অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করা হয়েছে। একইভাবে চালের বাজারে এখন যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে এ জন্যও ওইসব ইসু্যগুলোই দায়ী। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভর মৌসুমে চালের দাম বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণে স্বচেষ্ট না হয়ে বাজারকে বাজারের মতো ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে দাবি করেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম, আমদানি খরচ, লোকালি কনজাম্পশন ও ডলারের দাম বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এ মুহূর্তে তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হলে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হবে। ঝড় ও বন্যার পানি যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তেমনি বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা অনর্থক। বরং বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়া উচিত। বাজারই বলে দেবে, কী করতে হবে, আর কী না করতে হবে।' ব্যবসায়ী এই নেতা জানান, এই মুহূর্তে চালের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে একদিকে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি অন্যদিকে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হবে। কেননা কৃষকদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা ফলন ঘরে ওঠার পরপরই তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে। তাই এখন বাজারে চালের দাম কম হলে তাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অথচ অটো রাইস মিলাররা বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করার সুযোগ পাবে। মজুত আইনে তাদের ঠেকানোর কোনো সুযোগ না থাকায় এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। হেলাল উদ্দিন অভিযোগের সুরে বলেন, সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজার যথাযথভাবে মনিটর করছেন না। যে কারণে চালের 'প্রাইজ কারেকশন' হচ্ছে না। যা বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে চালের দামে লাগাম টানার চেষ্টা করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাজার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, পোল্ট্রি ফিড, গবাদিপশুর সব ধরনের খাদ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় গৃহস্থ ও খামারিরা অনেকে এখন হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলকে ভাত খাওয়াচ্ছে। এতে চালের উপর চাপ বাড়ছে। এখন এর নেতিবাচক প্রভাব টের পাওয়া না গেলে আগামীতে বাজারে এর বড় ধাক্কা লাগবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমান বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা বাড়লে তা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কেননা, চার সদস্যের একটি পরিবারে মাসে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ কেজি চালের প্রয়োজন হয়। এতে তাদের মাসিক খরচ দেড়শ' থেকে দুইশ' টাকা বাড়বে। তবে এ মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের কৃষক শ্রেণির বিশাল জনগোষ্ঠী যথেষ্ট উপকৃত হবে। এছাড়া চালের বাজার কিছুটা চড়া থাকলে অটো রাইস মিলারদের মজুতের কারসাজি অনেকটা কমবে।