ত্রাণ সমন্বয়হীনতায় বাড়ছে দুর্ভোগ

সিলেট সুনামগঞ্জের ৪৫ লাখ ক্ষতিগ্রস্তের জন্য বরাদ্দ ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল এবং প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার। সবার মধ্যে সমভাবে বণ্টন করা হলে মাথাপিছু ৪৪০ গ্রাম চাল এবং নগদ ৬.৫৫ টাকা পাবে। প্রতি দেড়শ' জনকে এক প্যাকেট শুকনো খাবার ভাগ করে নিতে হবে

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২২, ০৯:৩০

সাখাওয়াত হোসেন

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় সরকারিভাবে তাৎক্ষণিক বরাদ্দকৃত ত্রাণ বেশ অপ্রতুল। এর উপর তা বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না। বিশেষ করে যারা বন্যাকালীন সময় আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান না নিয়ে বিভিন্ন উঁচু টিলা, বেড়িবাঁধ, পাকা রাস্তা কিংবা পাকা দালানের ছাদে ঠাঁই নিয়েছেন, তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ বানভাসি মানুষ সরকারি বেসরকারি সব ধরনের ত্রাণ থেকে বঞ্চিত। কোথাও কোথাও চলছে ফটোসেশন সর্বস্ব ত্রাণ বিতরণ। বানভাসিরা জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে যারা অবস্থান করছেন, তারা খুব বেশি ত্রাণ পাচ্ছেন তা নয়। তবে তাদের তুলনায় দুর্গম এলাকায় এবং আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে থাকা মানুষের ত্রাণ প্রাপ্তির পরিমাণ খুবই নগণ্য। সরকারি-বেসরকারি সব ত্রাণ সমন্বয় করে বিতরণ করা হলে এ সংকট তৈরি হতো না। প্রায় প্রতিবছর বন্যা হলেও দুর্গত এলাকার মানুষকে উদ্ধার এবং তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে তেমন কোনো জলযান কেন রাখা হচ্ছে না- এটিও তাদের প্রশ্ন। প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণেই প্রতিবছর ত্রাণ বিতরণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে অভিযোগ করেন তারা। সিলেট বিভাগের জেলা প্রশাসন পরোক্ষভাবে বিষয়টি স্বীকার করে জানায়, তারা প্রত্যন্ত গ্রাম \হএবং আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য প্রাণনান্ত লড়াই করছেন, তাদের হাতে পর্যাপ্ত ত্রাণও রয়েছে। তবে তারা সেখানে পৌঁছাতে পারছে না। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকার হাজার হাজার গ্রাম সংকটের এই মুহূর্তে তাদের নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ দিতে এগিয়ে আসা কেউও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বেশিরভাগ মানুষ শহরাঞ্চলের আশপাশের মানুষদের ত্রাণ দিচ্ছে। ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে আনা ত্রাণ প্রশাসনের হাতে হস্তান্তর করা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের ১৩, সুনামগঞ্জের ১২, মৌলভীবাজারের ৭, ও হবিগঞ্জের ৬টি উপজেলা বন্যার কবলে পড়েছে। বন্যাকবলিত সব এলাকায় মিলে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৪ লাখ ৪ হাজার জন ১ হাজার ৪৭৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্তের জন্য মোট ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল এবং প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ হিসাবে মাথাপিছু ৪৪০ গ্রাম চাল এবং নগদ ৬.৫৫ টাকা পাবে। তবে শুধুমাত্র আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হলে প্রত্যেক ব্যক্তি পাবে ৪ দশমিক ৮৮ কেজি চাল ও ৭৩.৭৫ টাকা। শুকনো খাবারের ৩০ হাজার প্যাকেট শুধুমাত্র একই সংখ্যক লোককে বিতরণ করা যেতে পারে। তবে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ত্রাণ মজুত অপর্যাপ্ত নয়, বন্যার্তদের মাঝে বিলি করতে সরকার, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। চাহিদা অনুযায়ী আরও ত্রাণ বরাদ্দ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফরকালে সিলেট ও ??সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আরও ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মঞ্জুর করেছেন। তবে সিলেটের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা জানান, ঢাকা ও বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে আসা অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও মোম পৌঁছে দিয়েছে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে তারা ত্রাণ বিতরণ করেছেন। বন্যাকবলিত হওয়ার ছয় দিন সেখানকার বানভাসির প্রথম ত্রাণ পেয়েছে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের পাঁচপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বুধবার পর্যন্ত তারা কোনো সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাননি। অথচ তারা ৬ দিন ধরে পানিবন্দি। এই গ্রামের মানুষের ত্রাণ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিলুর রহমান বলেন, 'আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।' সিলেটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা ফারুক মাহমুদ চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় আছে। তবে এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। যা জেনে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বানভাসি প্রতিটি মানুষের হাতে দ্রম্নত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব, তা যতই দুর্গম এলাকা হোক- যোগ করেন ফারুক মাহমুদ। শুধু সিলেট, সুনামগঞ্জ বা নেত্রকোনাই নয়, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ নতুন করে পস্নাবিত প্রায় সব জেলাতেই ত্রাণ বিতরণে প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট বলে অভিযোগ করেন জনপ্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্য, বন্যাকালীন ও বন্যাপরবর্তী সময়ে বানভাসিদের যে পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন, কাগজে-কলমে তা দেওয়া হলেও প্রাপ্তির সঙ্গে এর যোগ-বিয়োগের ফল মেলে না। একই ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ পেলেও অনেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থাকেন। গত চারদিনে নতুন করে পস্নাবিত হওয়া কিশোরগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের প্রায় ১৩ হাজার মানুষ ২৫৪টি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে অবস্থানরতরা সরকারি ত্রাণ পেলেও এর বাইরে বানভাসি বেশিরভাগ মানুষ সেভাবে ত্রাণ পাননি। তবে জেলা প্রশাসক মো. শামীম আলমের দাবি, শুধু আশ্রয়কেন্দ্র নয়, সবখানে সরকারের বরাদ্দের ভিত্তিতে ত্রাণ তৎপরতা চলছে। আরও বরাদ্দ আসবে। সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এদিকে কুড়িগ্রামের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নসহ জেলার ৯ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক দুর্গত মানুষ পানিবন্দি। নদ-নদী অববাহিকার দিনমজুর ও কৃষক শ্রেণির এসব মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সরকারি-বেসরকারি সহায়তার দিকেই চেয়ে থাকেন। জুটলে পেট পুরে খেতে পারেন, নয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনাহার আর অর্ধাহারে দিন কাটান। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিপৎসীমার ওপরে থাকা ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সামান্য ওঠানামা করলেও, এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হওয়া বন্যায় বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে চর ও নিম্নাঞ্চলের পস্নাবিত হয়ে পড়া ঘর-বাড়ি ও নৌকায় অবস্থান করা মানুষ। তাদের ভাষ্য, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে বিতরণ কার্যক্রমের ধীরগতি এবং সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গত অনেক পরিবার ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে না। দুর্গত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানান, তারা যে বরাদ্দ পেয়েছেন তা এলাকার দুর্গত মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ কারণে সমন্বয় করেও তেমন লাভ হবে না। তাই তারা বরাদ্দ পাওয়া ত্রাণ সংকটে থাকা দুর্গতদের মধ্যে নিজেদের মতো করে বিতরণ করছেন। স্থানীয় একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জানান, তার এলাকায় বানভাসি পরিবার ৫ হাজার। তিনি মাত্র ৭ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। এ চাল সবার মধ্যে বিতরণ করা হলে পরিবারপ্রতি এক কেজি ৪শ' গ্রাম চাল ভাগে পড়বে। যা এক একটি পরিবারের এক বেলার খাবার হবে। তাই বরাদ্দকৃত চাল তিনি বেশি দুর্ভোগে থাকা ৭শ' পরিবারের মধ্যে বিতরণ করেছেন।