বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ছয় বছর

আজও গ্রেপ্তার হয়নি 'মাস্টারমাইন্ড জিয়া'

গাফফার খান চৌধুরী
  ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

দুনিয়া কাঁপানো হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গি হামলার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও 'মাস্টারমাইন্ড' বরখাস্তকৃত মেজর জিয়া আজও গ্রেপ্তার হয়নি। তাকে গ্রেপ্তার করতে সরকার ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে মেজর জিয়াসহ পলাতক দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। হলি আর্টিজানের সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলেও আজও সেই দিনটির কথা স্মরণ করে অনেকেই থমকে যান।

বৃহস্পতিবার হলি আর্টিজানে গিয়ে দেখা গেছে সেখানকার সব কিছুই চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। হলি আর্টিজান লাগোয়া লেক ভিউ ক্লিনিকে নিয়মিত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। হরদম গাড়ি ও মানুষজন যাতায়াত করছেন। ক্লিনিকটির দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এখনো অনেকের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। এক সময় বিদেশিরা নিয়মিত ক্লিনিকটিতে চিকিৎসা নিতেন। এখনো বিদেশিরা ক্লিনিকটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে সংখ্যায় আগের চেয়ে কম। ভীতি কিংবা আতঙ্ক থেকেও এমন হতে পারে।

হলি আর্টিজানে হামলার পর দেশে জঙ্গিবাদের নানা ইসু্যতের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর বাংলাদেশে

জঙ্গিবাদ আস্তানা গেঁড়ে বসার অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। হামলার পর দেশে চলে যাওয়া অধিকাংশ বিদেশিরা আবার বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। বিদেশিদের মধ্যে জঙ্গিবাদ ইসু্যতে আতঙ্কও প্রায় শতভাগ দূর হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তারপরেও সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদারসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পলাতক চাকরিচু্যত মেজর জিয়াসহ দূর্ধর্ষ জঙ্গিদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্তর্ যাব প্রায় ২ হাজার ৮শ' জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। যার মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলার পর সারাদেশের্ যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৬শ' জঙ্গি। যার মধ্যে প্রায় ৯শ' জনই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। বাকিরা অন্যান্য নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের। দেশে ভয়াবহ আকারে জঙ্গিবাদ বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই বলেও এই কর্মকর্তা দাবি করেন।

হলি আর্টিজানের গেটের দায়িত্বরতরা জানান, নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। শ্রদ্ধা নিবেদন ও ইতিহাসের বিষাদময় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি বছরই লোকজন আসেন। এবারো আসবেন। প্রতি বছরের মতো এবারো ভিড় করবেন দেশি-বিদেশিরা। এজন্য শুক্রবার সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের জন্য বাড়িটি খোলা রাখা হবে।

\হদেশে জঙ্গিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিআইজি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর টানা অভিযানে জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে অনেক জঙ্গি। গ্রেপ্তারদের জবানবন্দি বিবেচনা করে ৫১২ জনকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী কাজ চলছে। চলছে বিশেষ অভিযান। আত্মগোপনে বা পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হলি আর্টিজানসহ লেখক, প্রকাশক, বস্নগারসহ বিভিন্ন জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত হিসেবে চাকরিচু্যত মেজর জিয়ার নাম এসেছে। চাকরিচু্যত মেজর জিয়াসহ পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তার অবস্থান জানতে বিদেশেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে জঙ্গিরা আর আগের মতো সুবিধা করতে পারছে না। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তারা দলে লোক ভিড়াতে পারছে না। তারা বিভিন্ন গোপন অ্যাপস ব্যবহার করে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদ বিস্তারে কাজ করার চেষ্টা করে চলেছে। এমন অনেক অ্যাপসকে আমরা শনাক্ত করেছি। এসব অ্যাপস পরিচালনাকারীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। সেলস রেডিক্যালাইজড হওয়ার সংখ্যাও কমে গেছে। যেসব গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ বিষয়ে প্রচারণা চালানো হয়, সেগুলোও আমরা শনাক্ত করেছি। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সব সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে।

তিনি আরও জানান, আমরা সারাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করার কাজ করছি। ইতোমধ্যেই দেশের ৪৮টি জায়গায় সমাজের সব স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করেছি। ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। যারা ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা দেবেন। কারণ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েই জঙ্গিবাদের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়।

ডিএমপির গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, আগতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বাড়িটিসহ আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আশপাশের এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে পুরোএলাকা মনিটরিং করা হবে। প্রতিটি রাস্তার প্রবেশ পথে থাকছে চেকপোস্ট। প্রতি বছরের মতো এবারো হয়তো ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে ভিড় করবেন দেশি-বিদেশিরা। দুপুর ১২টায় ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গিরা ভয়াবহ হামলা চালায়। হামলায় প্রথম দফায় নিহত হন বনানী মডেল থানার ওসি সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। এরপর জঙ্গিরা রেস্তোরাঁর সবাইকে পয়েন্ট টু টু বোরের অটোমেটিক রাইফেলের মুখে জিম্মি করে। তখন পবিত্র মাহে রমজানের রোজা চলছিল। জিম্মির পর জঙ্গিরা ইটালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের এক জন ও তিন বাংলাদেশিকে গুলি করে ও নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। জঙ্গিরা ওইদিন ২২ জনকে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের বীভৎস ছবি তুলে রেখেছিল।

এমন ঘটনার পর পরই দায় স্বীকার করে আইএসের নামে সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি অনলাইন পোর্টাল থেকে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ওই বিবৃতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে বলে নানাভাবে প্রপাগান্ডা চালানোর চেষ্টা করা হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে আইএস তৎপরতা রয়েছে দাবিও করছিল।

ওইদিন ভোরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা 'অপারেশন থান্ডার বোল্ট' পরিচালনা করেন। অভিযানে হামলাকারী জঙ্গি নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হন। অভিযানে রেস্তোরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও মারা যান। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে তিন বিদেশিসহ ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করেন। সবমিলিয়ে জিম্মিদশা থেকে ৩৩ জন জীবিত উদ্ধার হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে