নির্বাচন নিয়ে সংসদে উত্তাপ

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
নির্বাচনী ব্যবস্থা কী রকম হবে তা নিয়ে বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয় সংসদে। বাজেটের মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনার সময় নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বিএনপির সদস্যরা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি তুলেছেন। এ সময় ইভিএম-ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের বিষয়ে বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্যরা তাদের মত দেন। বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত দায়যুক্ত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কিত মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বরাদ্দের দাবি নিষ্পত্তির সময় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় আইনমন্ত্রী বলেন, বিএনপি বারবার বলছে, তাদেরকে নির্বাচনে আনতে হবে। তারা কি পাকিস্তানে থাকে যে সেখান থেকে ডেকে আনতে হবে? তারা তো বাংলাদেশে থাকে। উনারা নির্বাচন করতে চাইলেই নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের যে জন্য পেস্নইং ফিল্ড দরকার সেটা করা হবে। তার এ পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। সেটা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, এখন বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে, তাহলে উনারা ভোটে আসবে। এই সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের এক সুতাও বাইরে সরকার যাবে না। জবাবে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বলিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়াতে কোনো কৃতিত্ব নেই। মাঠে মূল পেস্নয়ার দুইটা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলকেই মাঠে রাখতে হবে। এ সময় জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ করে দিতে না পারে তাহলে নির্বাচন কমিশন ঢাকায় বসে কিছুই করতে পারবে না। সবাই নির্বাচনে জিততে চায়। এখানে কোনো এথিকস মানে না। নির্বাচনে যার শক্তি বেশি, সেই সিল মারবে। যেদিকে শক্তি বেশি থাকে, স্থানীয় প্রশাসনও সেদিকে চলে যায়। আসলে নির্বাচন কমিশনসহ কোনো কমিশনই স্বাধীন নয়। সব সরকারের আমলেই এটি হয়েছে, এটি চলতেই থাকবে। একই দলের রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ইভিএমের কোনো দোষ নেই। যারা ইভিএমে প্রভাব খাটায় ব্যালটেও তারা প্রভাব খাটাতে পারে। এ বিষয়টি বন্ধ করতে হবে। জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ। নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তত যৌক্তিকতা হারাবে। তিনি ইসির অধীনে 'নির্বাচনী পুলিশ' গঠনের প্রস্তাব করেন। ওই দলের সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের 'অনাস্থা তৈরি হয়েছে' দাবি করে বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে প্রশাসন। তিনি নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ অর্থ প্রশাসন ও পুলিশকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনোভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না মন্তব্য করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ ইভিএমের বিরোধিতা করে বলেন, সাবেক সিইসি নূরুল হুদা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছু ত্রম্নটি আছে। তাহলে তিনি কেন ইভিএমে নির্বাচন করলেন? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন কক্ষে থাকা ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ ইভিএম চায় না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একসময় বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন বিএনপিকে ছাড়া কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে? পারবেন না। বিএনপিকে কীভাবে নির্বাচনে আনবেন সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে অবশ্যই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। সে জন্য নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে। বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, যখন দেশে নির্বাচন থাকে তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। যদি নির্বাচন না থাকে, দিনের ভোট রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে? তিনি বলেন, সিইসি বলেছেন, ভোটের মাঠে বিএনপিকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকতে হবে। ভোট কি যুদ্ধ? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এই ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়। পুলিশ প্রশাসনও এই ডাকাতি করে। এই ডাকাতির পর যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় ভবিষ্যতে ডাকাত আরও বাড়বে। কুমিলস্না সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারেনি। তার হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারেনি। বারবার অনুরোধ করে তাকে এলাকা থেকে সরাতে পারেনি। যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না তারা জাতীয় নির্বাচনে তিনশ সংসদ সদস্যকে কীভাবে সামলাবেন? বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের একটি পুরনো খেলা আছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকলে তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু করা হয়। ২০১৪ সালেও এই খেলা দেখা গেছে। গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল কারণ তারা (ইসি) সরকারের আজ্ঞাবহ। চারটি দল শুধু ইভিএমের পক্ষে আর বেশিরভাগই বিপক্ষে। আজ্ঞাবহ না হয়ে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইভিএম বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিরোধী সদস্যদের আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে নির্দলীয় সরকার আনার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখানকার আসনে বসে বলছেন নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি সংসদে গেলেন কীভাবে? এর জবাব উনি দেবেন। বিএনপি আমলে ভোটের চিত্র তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, 'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ওই সময় কারও ভোট কেন্দ্রে যাওয়া লাগত না, ভোট হয়ে যেত। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন তাদের (বিএনপি) ছিল। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রম্নম্নয়ারি বিএনপি কী করেছে, এগুলো কি উনারা ভুল গেছেন?' বিএনপির সদস্যদের নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ ছাঁটাই করে এক টাকা দেওয়ার প্রস্তাবের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, উনারা বলেছেন এক টাকা দিতে। উনারা পারবেন এক টাকা দিয়ে কোনো নির্বাচন করে দিতে? পারবেন না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের টাকা লাগবে। নির্বাচন কমিশন তার অর্থ ব্যয়ে পুরোপুরি স্বাধীন।