বিজয় উৎসবে মাতোয়ারা দেশ

প্রকাশ | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
রোববার মহান বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল নামে। ছবিতে লাল-সবুজের পতাকা হাতে শিক্ষাথীের্দর উচ্ছ¡াস Ñযাযাদি
বঁাধনহারা আনন্দ-উচ্ছ¡াসে মাতোয়ারা কোটি প্রাণ বিজয় উৎসবের নানা আয়োজনে। জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে শুরু করে রাজধানীর নানা আঙিনা ছুঁয়ে প্রত্যন্ত জনপদে বয়েছে অনাবিল আনন্দের ঢেউ। দেশব্যাপী নানা কমর্সূচিতে উদযাপিত হলো ৪৮তম মহান বিজয় দিবস। ধ্বনিত হলো অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার। কোটি কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। নানা কমর্সূচিতে প্রতিফলিত হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলার শপথ। দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে সোনার বাংলা বিনিমাের্ণর প্রত্যয়ও উচ্চারিত হয়েছে কোটি কণ্ঠে। গোটা জাতি এদিন গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিনম্রচিত্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় শহীদ বীর সন্তানদের স্মরণ করেছে। নিবেদন করেছে প্রাণের শ্রদ্ধাঘ্যর্। মুক্তিযুদ্ধে হারানো স্বজনের জন্য কেঁদেছে স্বজন। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ঢল নামে জনতার। দিনভর নানা আয়োজনে বিজয়োৎসবে মেতে ওঠে সবর্স্তরের মানুষ। বিজয়ের রঙে সাজেন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা। রোববার রাজধানীর তেজগঁাও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সূযোর্দয়ের সময় ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কমর্সূচি। সব সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ভবনে উত্তোলিত হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অজির্ত লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। সব রকমের যানবাহনে শোভা পেয়েছে ছোট ছোট পতাকা। আগের রাত থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ বিজয়ের উৎসবে মেতে ওঠার প্রস্তুতি শুরু করে। সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলোকে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি রংবেরঙের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বেলুন দিয়ে বণার্ঢ্য সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। বড় বড় সড়ক-মহাসড়কে রাজনৈতিক নেতাদের নামে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে শত শত তোরণ বানানো হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন দল, সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগে পাড়ায়-পাড়ায় এবং অলিগলিতে মাইকে বেজেছে দেশাত্মবোধক গান এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় ভাষণ। গতকাল রোববার ছিল সরকারি ছুটির দিন। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ সব বেসরকারি টিভি ও রেডিওতে সারাদিন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ সারাদেশের মসজিদগুলোতে দেশ ও জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির, গিজার্, প্যাগোডাসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে অনুরূপ প্রাথর্না অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। দেশের সব শিশুপাকর্ ও জাদুঘর বিনা টিকিটে উন্মুক্ত রাখা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ: সূযোর্দয়ের ক্ষণ সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তারা। বিউগলে করুণ সুর বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। পরে সিইসি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে ইসি কমিশনাররা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন। এরপর বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে একে একে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো হয়। একপযাের্য় লাখো মানুষের ঢল নামে সেখানে। শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন সংগঠন ও জনতার সারি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে নবীনগর পযর্ন্ত পেঁৗছে যায়। সৌধ প্রাঙ্গণ পরিণত হয় বিশাল জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার সকালে রাজধানীর ধানমÐিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করে শ্রদ্ধা জানান তিনি। এ সময় তিনি দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে কিছুক্ষণ নীরবে দঁাড়িয়ে থাকেন। এরপর আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে আরেকটি পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন। পরে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি সবর্স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সবর্স্তরের মানুষের সরব উপস্থিতিতে ওই এলাকা তখন জনারণ্যে পরিণত হয়। শহীদ পরিবারকে বিজিবির সংবধর্না: মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎবরণ করা বিজিবির খেতাবপ্রাপ্ত দুজন বীরশ্রেষ্ঠ, ৮ জন বীর-উত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম ও ৭৭ জন বীরপ্রতীকের পরিবারের সদস্যদের সংবধর্না দিয়েছে বডার্র গাডর্ বাংলাদেশ (বিজিবি)। রোববার দুপুরে পিলখানার দরবার হলে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের এই সংবধর্না দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাতে উপহার সামগ্রী ও আথির্ক অনুদান তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন। এর আগে সকালে বিজয় দিবস উপলক্ষে পিলখানার ‘সীমান্ত গৌরব’ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন বিজিবি মহাপরিচালক? এ সময় বিজিবির একটি সুসজ্জিত দল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গাডর্ অব অনার প্রদান করেন। শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ্জ্জুামান খান কামাল। শহীদদের স্মরণ করে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন পুলিশ মহাপরিদশর্ক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার ও বাংলাদেশ পুলিশ সাভির্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আছাদুজ্জামান মিয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়াকর্ ও বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকেও স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বিউগলে বাজানো হয় জাতীয় সংগীত। এ সময় ডিএমপির একটি চৌকস দল গাডর্ অব অনার প্রদান করে বীর শহীদদের সম্মান জানান। রাজধানীতে উৎসবের আমেজ: বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হয়। শিশুপাকর্, জাতীয় জাদুঘরে রোববার সকাল থেকেই ভিড় ছিল। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় শাহবাগ, হাতিরঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। অনেকের পরনেই ছিল লাল-সবুজের পোশাক। কারো মাথায় ছিল ফিতা। সকাল থেকে জাতীয় পতাকা লাল-সবুজে যেন সেজেছিল নারী-পুরুষসহ সব বয়সীরা। সবাই বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়েন পথে পথে। অনেকের মুখমÐলে শোভা পেয়েছে লাল-সবুজের আলপনা কিংবা জাতীয় পতাকার ছবি। সকল বয়সের মানুষের উপস্থিতি আর তাদের চোখে-মুখের আনন্দ-উচ্ছ¡াস বলে দিয়েছে আজ বাঙালির জীবনের আনন্দের দিন। অনেকে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে রিকশা ভ্রমণ কিংবা আড্ডা জমিয়ে বসেছেন শাহবাগ মোড়ে। কেউবা আবার ঘোড়ার গাড়িতে আনন্দে মেতেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও আরো বাড়তে শুরু করে। নিবিের্ঘœ উদযাপন: কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই রাজধানীসহ সারাদেশে নিবিের্ঘœ মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে রাজধানীতে ছিল নিñিদ্র নিরাপত্তা। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূণর্ সড়কে টহল জোরদার করা হয়। পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যরা ছাড়াও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। নিবার্চনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি থাকায় এবারের বিজয় দিবসে অন্যান্য বছরের তুলনায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।