৩৫ দফা ইশতেহার ঘোষণা

রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ঐক্যফ্রন্টের

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা থাকবে না পরপর দুই মেয়াদের বেশি একজন প্রধানমন্ত্রী নন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার ঘোষণা বিদেশে পাচার করা অথর্ ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের ঘোষণা সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন

প্রকাশ | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:১০

যাযাদি রিপোটর্
সোমবার ঢাকার হোটেল পূবার্ণীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেন ও মিজার্ ফখরুল ইসলাম ইলমগীর Ñফোকাস বাংলা

একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে জিতে ক্ষমতায় গেলে ‘রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার’ প্রতিশ্রæতি এসেছে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে দুই মাস আগে গঠিত এই জোট বলছে, ২০১৪ সালে ‘নিবার্চনের নামে প্রহসনের’ মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণ হারিয়েছিল। সেই মালিকানা তারা ৩০ ডিসেম্বর ভোটে জিতে আবার ‘সব জনগণের’ হাতে ফিরিয়ে দিতে চায়, যার মধ্যে পরাজিতরাও থাকবে। ঐক্যফ্রন্টের শীষর্ নেতা ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে সোমবার ঢাকার হোটেল পূবার্ণীতে ৩৫ দফা প্রতিশ্রæতি রেখে এই নিবার্চনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ডান দিকে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বঁা দিকে ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। ড. কামাল হোসেনের প্রারম্ভিক বক্তৃতার পর মান্না ঐক্যফ্রন্টের নিবার্চনী ইশতেহার পড়ে শোনান। ড. কামাল হোসেন তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নিবার্চনের নামে এই প্রহসনটি হয়েছিল, সেটি সংবিধান বণির্ত জনগণের প্রত্যেকের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নিবার্চনের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সাংঘষির্ক। এই নিবার্চনের মাধমে জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়েছিল।’ গত ১০ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে দলটির সাবেক নেতা ড. কামাল বলেন, ‘জনগণ যখন মালিক থাকে না, তখন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে পড়ে কায়েমি স্বাথর্বাদী গোষ্ঠী, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠী। এর মাশুল দিতে হয়েছে এ দেশের মানুষকে। এটা আপনারাও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছেন।’ ইশতেহার পড়ে শুনিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ক্ষমতায় গেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার বয়সসীমা তুলে দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাযর্ক্রম চলমান রাখবে। সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের তালিকা করবে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করবেÑ এমন অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। ঐক্যফ্রন্টের ৩৫ দফা ইশতেহারের মধ্যে রয়েছেÑ রাষ্ট্র পরিচালনায় পরাজিতদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। ডেপুটি স্পিকার হবে বিরোধী দল থেকে। তারা নিবার্চনকালীন সরকারের বিধান তৈরি করবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়া হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাযর্ক্রম চলমান রাখার পাশাপাশি তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেয়া হবে। ইশতেহারে আরও রয়েছেÑ মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা থাকবে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশে সরকারি বিধি-নিষেধ থাকবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ বাজেটের ৩০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া ঢাকার কাছে উন্নত নাগরিক সুবিধাসহ কয়েকটি শহর গড়ে তোলা হবে। ঐক্যফ্রন্ট বলছে, পুলিশ ও সামরিক বাহিনী বাদে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোনো বয়সসীমা থাকবে না। অনগ্রসর ও প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কারও জন্য কোটা থাকবে না। ৩০ বছরের বেশি শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা চালুর জন্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দেখতে কমিশন গঠন, পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নিবার্চন নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে প্রশাসনের হাতে দেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভতির্ পরীক্ষার পদ্ধতি চালু হবে। ক্ষমতায় গেলে ঐক্যফ্রন্ট দুনীির্ত দমনে ব্যবস্থা নেবে। দুনীির্তর তদন্তের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, দুনীির্তবাজ সরকারি কমর্কতাের্দর গ্রেপ্তারে সরকারের অনুমতির বিধান বাতিল করা হবে। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে ঐক্যফ্রন্টের। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা, সব জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, সিসিইউ, আইসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার এবং ক্যান্সারের কেমোথেরাপি সেন্টার গড়ে তুলবে ঐক্যফ্রন্ট। ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ কমানোর কথাও বলেছে তারা। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩-এর সংস্কারসহ খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধাযর্ করা হবে। বিচারবহিভ‚র্ত হত্যাকাÐ, গুম, রিমান্ডে নিযার্তন পুরোপুরি বন্ধের কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। রিমান্ডের নামে পুলিশি হেফাজতে যেকোনো ধরনের শারীরিক নিযার্তন বন্ধ করা হবে। সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া মামলাজট কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে উচ্চ আদালতের বাষির্ক ছুটি ছয় সপ্তাহে সীমিত করা হবে। বিভাগীয় সদরে স্থায়ী হাইকোটর্ বেঞ্চ হবে। সুপ্রিম কোটের্র বিচারপতিদের অবসরের বয়স করা হবে ৭০ বছর। কৃষিতে ভতুির্ক বাড়ানো, শিল্পোন্নয়ন, ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছরের মধ্যেই শ্রমিকদের মজুরি ১২ হাজার টাকা করার কথা বলছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাংক পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সবর্ময় ক্ষমতা দেয়া হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনমূর্ল্যায়ন করা হবে। বয়স্কভাতা চালু, পুনবার্সন ছাড়া হকার উচ্ছেদ না করাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কমর্সূচি নেবে ঐক্যফ্রন্ট। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রথার পরিবতের্ সরাসরি নিবার্চনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ২০ শতাংশ মনোনয়ন বিধান করে দুই মেয়াদের পর আর সংরক্ষিত আসন না রাখার কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। এ ছাড়া কোনো বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়াই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর করা হবে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় শিক্ষাথীের্দর ওপর হামলাকারীদের বিচার এবং শিক্ষাথীের্দর ৯ দফার আলোকে সড়ক আইন সংশোধন করা হবে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় দায়িত্বরত সাংবাদিক নিগ্রহের বিচারের কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। প্রবাসীদের ভোটাধিকারসহ প্রবাসী কমীের্দর বিমানবন্দরে সবোর্চ্চ সুবিধা দেয়া হবে। সাংবাদিকদের মজুরি বোডর্ নিয়মিত করা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাতে উৎসাহ প্রদানসহ সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হবে। ইন্টারনেট ও মোবাইল খরচ অধেের্ক নামিয়ে আনা, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় করা, তাদের ওপর হামলার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করা। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে দ্রæত সমাধান করার কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহŸায়ক ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী ও মোস্তফা মহসীন মন্টু, বিএনপির আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরউল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।