বাসভাড়া বাড়লেও নৈরাজ্য কমেনি

সিএনজিচালিত বাসেও বেশি ভাড়া আদায় বিআরটিএসহ কোনো সংস্থার তদারকি নেই

প্রকাশ | ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রাজধানীর মিরপুর থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার দুই টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ৩২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু নেওয়া হতো ৪০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ৩৫ পয়সা বেড়ে প্রতি কিলোমিটারে বাসের ভাড়া হয়েছে দুই টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে মিরপুর-গুলিস্তানের ভাড়া হবে ৩৭ টাকা ৫০। কিন্তু পরিবহণ শ্রমিকরা ৬০ টাকা দাবি করছে। একইভাবে রাজধানীর গাবতলী থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিলোমিটারে দুই টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। কিন্তু নেওয়া হতো ৩০ টাকা। নতুন ভাড়ায় মতিঝিল-গাবতলীর ভাড়া হবে ৩০ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। গতকাল রোববার বাসের ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনে রাজধানীর প্রতিটি রুটেই এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এ নিয়ে কোথাও কোথাও পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। দাবিকৃত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানালে অনেক যাত্রীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার যাত্রীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের ওপর চড়াও হয়েছে। ক্ষুব্ধ যাত্রীদের অভিযোগ, আগেও বেশি ভাড়া নিত। ভাড়া বাড়ানোর পরও সে নৈরাজ্য কমেনি। বরং তা আরও বেড়েছে। নজরদারি না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বরাবরের মতো উদাসীন রয়েছে। সরেজমিন নগর পরিবহণ ও দূরপালস্না উভয় রুটের বাসেই খেয়াল খুশিমতো ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। বাসের নতুন ভাড়া ঘোষণার পর নগর পরিবহণের চলা পুরনো নৈরাজ্য আরও বেড়েছে। সিটি সার্ভিসের কোনো বাসেই নতুন ভাড়ার তালিকাও দেখা যায়নি। নির্ধারিত ভাড়ার বেশি কোনো পরিবহণে আদায় করা হচ্ছে কিনা-তা দেখভালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মাঠে নামেনি। এদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভাড়া বাড়ানো হলেও নগর পরিবহণের সিএনজিচালিত বাসগুলোও বর্ধিত ভাড়া আদায় করেছে। এ ব্যাপারে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি। সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির পর ডিজেল ও গ্যাসচালিত বাস আলাদা করে ভাড়া নির্ধারণের চেষ্টা করেও যেমন লাভ হয়নি, এবারও সেই একই অবস্থা হয়েছে। সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ঘুরে এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে বিপুলসংখ্যক বাসের উইন্ডশিল্ডে 'সিএনজিচালিত' লেখা স্টিকার দেখা গেলেও রোববার সকাল থেকে তা ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলা ৩৬ নম্বর বাসের যাত্রী আশরাফুল হক জানান, সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া না বাড়লেও এ বাসের কন্ডাক্টর তার কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়া আদায় করেন। বাসটি ডিজেলচালিত বলে চালক দাবি করলেও বাসের পেছনে গ্যাসের সিলিন্ডার দেখা গেছে। যাত্রীরা বলছেন, কোন বাস সিএনজিতে চলে আর কোন বাস ডিজেলে চলে, তা তাৎক্ষণিক যাত্রীদের বোঝার উপায় নেই। এ কারণে নগর সার্ভিসের প্রতিটি বাস গ্যাসে, নাকি ডিজেলে চলে তা যাচাই করে স্টিকার দেওয়া উচিত। এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তা নিয়মিত তদারকি করা জরুরি। অথচ কখনো তা করা হয়নি। এ কারণে গ্যাসের দাম বাড়লে ডিজেলচালিত বাস তাদের ভোল পাল্টে ফেলে। আবার ডিজেলের দাম বাড়লেও একই অবস্থা হয়। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। এদিকে শুধু নগর পরিবহণেই নয়, দূরপালস্নার বাসেও ভাড়া নৈরাজ্য দেখা গেছে। ঢাকা থেকে দূরপালস্নার বিভিন্ন গন্তব্যে বাসভাড়া ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা বাড়তি নেওয়া হয়েছে। আর বিলাস বহুল বাসগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। রোববার গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনাল ঘুরে দূরপালস্নার বাসে এ নৈরাজ্য দেখা গেছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে আগে খুলনার ভাড়া ছিল ৬৯০ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। যশোরের ভাড়া ছিল ৫৫০ টাকা। এখন ৬৫০ টাকা। কুড়িগ্রামের ভাড়া ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে এক হাজার টাকা। রংপুরের ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা, এখন ৮৫০ টাকা। নওগাঁর ভাড়া ছিল ৫৫০ টাকা, এখন ৭০০ টাকা। বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনার ভাড়া বেড়েছে ১০০ টাকা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দূরপালস্নার পথে সরকার বাসভাড়া বাড়িয়েছে ২২ শতাংশ। কিন্তু মাইলেজ হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতিটি রুটেই গণপরিবহণ মালিকদের নির্ধারিত ভাড়া সরকারি ভাড়ার চেয়ে ৮ থেকে ১৩ শতাংশ বেশি। আম ব্যবসায়ী নূর উদ্দিন জানান, গত বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল গেছেন ২০০ টাকা বাসভাড়া দিয়ে। কিন্তু রোববার তাকে একই পথে ভাড়া গুনতে হয়েছে ৩০০ টাকা। এ হিসাবে তার কাছ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। নওগাঁ থেকে আসা আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি আগের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি ভাড়া দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। এ নিয়ে নওগাঁ ও ঢাকার কাউন্টারে কথা বলেছেন। কিন্তু পরিবহণ কর্তৃপক্ষ কোনো সদুত্তর দেয়নি। তবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণপরিবহণে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিলে জনস্বার্থে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। মালিকরা প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে। তবে রোববার রাজধানী কিংবা দূরপালস্নার পথে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থার তৎপরতা চোখে পড়েনি। আলতাব হোসেন নামের একজন বাসযাত্রী জানান, রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে তিনি মিরপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী আল-মক্কা পরিবহণের বাসে চড়েন। শনিবার তিনি ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে মিরপুর-১ নম্বর থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের তিব্বত পর্যন্ত আসেন। তবে রোববার এ গন্তব্যে তার কাছে ৩০ টাকা দাবি করা হয়। গুলিস্তানগামী যাত্রীদের কাছে চাওয়া হয় ৬০ টাকা। অথচ গুলিস্তান পর্যন্ত আগে ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। এ হিসাবে মিরপুর-গুলিস্তান রুটে পরিবহণ শ্রমিকরা ২০ টাকা ভাড়া বেশি দাবি করছেন। অথচ নতুন রেট অনুযায়ী ১০ টাকা ভাড়া বাড়ার কথা। আলতাব হোসেন আরও জানান, সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা চাওয়ায় ক্ষুব্ধ বাসযাত্রীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তারা আদায়কৃত ভাড়া ফেরত দিতে বাধ্য হলে বাসটি গুলিস্তান পর্যন্ত যায়নি। গুলশান-লিংক রোডের সব যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে বাসটি মিরপুরের দিকে চলে যায়। সংবাদকর্মী আমানুর রহমান জানান, তিনি রোববার দুপুরে ইকবাল পরিবহণের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে রায়েরবাগ থেকে রামপুরার আবুল হোটেল পর্যন্ত আসেন। এক দিন আগেও এ গন্তব্যে ৫০ টাকা ভাড়া দিলেও রোববার তার কাছ থেকে ৭০ টাকা নেওয়া হয়। সাইনবোর্ড থেকে উত্তরা পর্যন্ত এ বাসে আগে ভাড়া ১০০ টাকা ছিল, এখন নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫০ শতাংশ। অথচ সরকার নির্ধারিত নতুন রেটে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১৬ শতাংশ। রাজধানী পরিবহণে ত্রিমোহনী থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত আসা বাসযাত্রী শামীম আহমেদ জানান, এ দূরত্বে আগে ভাড়া ছিল ১০ টাকা। অথচ রোববার নেওয়া হয়েছে ১৫ টাকা। ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে পরিবহণ শ্রমিকরা সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে আড়াই টাকা বেশি আদায় করেছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ডক্টর সামছুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার পরও এমন নৈরাজ্যে সরকারের আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। বরাবরের মতো মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি না থাকায় এই সুযোগ নিচ্ছেন পরিবহণ ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা জানেন এর ফলে তাদের কিছুই হবে না। তাই জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধি ও ভাড়া সমন্বয়ের পরও তারা খোলামেলাভাবে যাত্রী হয়রানি করে চলছে। তিনি আরও বলেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এ খাতে কোনো অভিভাবক নেই। এই অত্যাচারের দায় সরকার বিশেষ করে যোগাযোগমন্ত্রীকে নিতে হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও তারা বিআরটিএসহ তদারকি সংস্থারগুলোর মধ্যে নূ্যনতম স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এই পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত হইচই করে ভাড়া নির্ধারণ করে কী লাভ? আগেও কেউ সরকার নির্ধারিত রেটে ভাড়া নেয়নি। এখনো নিচ্ছে না। গণপরিবহণে শৃঙ্খলা না থাকায়, এবারও তালিকা মেনে ভাড়া আদায় হবে না। গণপরিবহণে আগে শৃঙ্খলা জরুরি। যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ : এদিকে আমাদের নাটোর প্রতিনিধি জানান, বাসভাড়া বেড়ে যাওয়ায় নাটোর থেকে বিভিন্ন রুটে যাত্রীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। রোববার নাটোর বাস টার্মিনালে কথা হয় আব্দুর রহমান, শরিফ ও রওশন আরার সঙ্গে। তারা জানান, আগে নাটোর থেকে ঢাকার ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা, এখন সেখানে ভাড়া নিচ্ছে ৬০০ টাকা। রাজশাহীতে চাকরিরত করিম নামের এক যাত্রী জানান, আগে নাটোর থেকে রাজশাহী যেতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা নিত। এখন সেখানে ৯০ থেকে ১০০ টাকা ভাড়া আদায় করছে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে সরকারের ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত ছিল। পরিবহণ শ্রমিক বলেন, তারা বরাবরই যাত্রী ও মালিক পক্ষের চাপে থাকেন। ভাড়া বৃদ্ধি করায় তাদের সঙ্গে বাসযাত্রীদের বাগ্‌বিতন্ডা হচ্ছে। আবার মালিকের কাছে ভাড়ার টাকা জমা দিতে গিয়েও চাপে পড়ছেন।