শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ভাড়া বেশি নেওয়ায় রাইদা পরিবহণকে জরিমানা

ভাড়া নৈরাজ্যে যাত্রী ক্ষোভ বাড়ছে

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারে ছিল তীব্র যানজট। ছবিটি সোমবার তোলা -ফোকাস বাংলা

সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও সোমবার বাসে খেয়ালখুশিমতো বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বাস্তবে 'কঠোর ব্যবস্থা' নিতে দেখা যায়নি কাউকে। মুষ্ঠিমেয় বাসে জরিমানা আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যাবতীয় তৎপরতা। ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে এসব হুঁশিয়ারি লোক দেখানো কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে, সরকারিভাবে নতুন করে বড় ধাপে গণপরিবহণের ভাড়া বাড়ানোর পর বাস শ্রমিকরা তার চেয়ে বেশি টাকা আদায় করায় যাত্রী ক্ষোভ হু হু করে বাড়ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন রুটে গণপরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। এ উত্তাপ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সোমবার রাজধানীর মিরপুর, গাবতলী, আসাদগেট, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন সড়কে গত দুই দিনের তুলনায় বাসের সংখ্যা কিছুটা বেশি। সকাল ও বিকালের পিক আওয়ারে প্রতিটি গাড়িই ছিল যাত্রীতে ঠাসা। যাত্রীরা জানিয়েছেন, রোববারের মতো সোমবারও একই কায়দায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। প্রতিবাদ করলে পরিবহণ শ্রমিকরা যাত্রীদের হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে। কাউকে কাউকে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়েছে। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা চাওয়ায় ফুঁসে উঠেছে। কোথাও কোথাও যাত্রীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি।

এদিকে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ৪৮ ঘণ্টা পরও গতকাল নগর সার্ভিসের কোনো বাসে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। অথচ ভাড়ার তালিকা লাগানোর ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বিআরটিএ বারবার বলছে, সিএনজি, অকটেন ও পেট্রোলচালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (সিএনজি) চলা পরিবহণেও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন

যাত্রী-পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। তবে বাড়তি ভাড়া গোনাতে অধিকাংশ যাত্রীর কণ্ঠে অসহায়ত্বের সুর। যাত্রীরা বলছেন, তাদের আয় বাড়েনি কিন্তু ছোট ছোট পরিবহণেও ভাড়া বেড়েছে। এটি তাদের ওপর একটি বিশাল চাপ তৈরি করেছে।

এদিকে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পুনর্র্নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করলে দায়ী পরিবহণের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ার দিলেও মামলা ও জরিমানার সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। তবে বাসে যে ব্যাপক হারে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে- সে কথা বিআরটিএর কর্তাব্যক্তিরাও স্বীকার করেছেন। সুযোগ বুঝে সিএনজিচালিত বাসগুলোও বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে বলে জানান তারা।

তবে বিআরটিএর পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, চালক-শ্রমিককে জরিমানা করে ফল হবে না। মালিকের নির্দেশে তারা অতিরিক্ত ভাড়া নেন। তাই মালিককে জরিমানা করতে হবে, যাতে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। আগামীতে এ ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের বলা হবে। তবে অতিরিক্ত ভাড়া নিলে কিংবা গাড়ির হালনাগাদ কাগজ না থাকলে গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বিআরটিএর। কিন্তু সরাসরি মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজার প্রতিবাদে সড়কে বাস রেখে ঢাকা অচল করে দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা জানান, সে কারণে চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না।

সরেজমিন দেখা গেছে, জিগাতলা থেকে রামপুরা পর্যন্ত তরঙ্গ পরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫ টাকা। তারা এখন নিচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। একই চিত্র দেখা গেছে সায়েদাবাদ-টঙ্গী রুটের বলাকা বাসে। এই মিনিবাসে মতিঝিল থেকে মহাখালী পর্যন্ত ভাড়া ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। কিন্তু তারা নিচ্ছে ২৫ টাকা।

আসাদগেট এলাকায় আজিজুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, 'বাধ্য হয়েই আমাদের গণপরিবহণে চলতে হয়। আর তাদের দাবি অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। আমরাতো কোণঠাসা হয়ে পড়ছি।' এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা। তারা বলছেন, আয় না বাড়লেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যয় প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

বাসযাত্রী রেজা বলেন, 'তেলের দাম বেড়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়াও বেড়েছে। তাতেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বাসের হেলপাররা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন এবং তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রোডে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি নিচ্ছে। এসব বিষয়গুলো কি কারও নজরে পড়ছে না।'

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শাহীন বলেন, 'ভাড়ার চার্ট যেন দ্রম্নত প্রতিটি বাসে রাখা হয় এবং সে অনুযায়ী যেন ভাড়া আদায় করা হয়, যাত্রী হিসেবে আমাদের এটাই চাওয়া। একদিকে ভাড়া বেড়েছে আর সে কারণেই আজ যেন ভোগান্তিতে না পড়তে হয় এ বিষয়টি যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজরে আনেন।'

বাসের জন্য অপেক্ষারত সুজন বলেন, 'বাসভাড়া বাড়ার পর সরকারের কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যে ধরনের নজরদারির প্রয়োজন ছিল; তাতে ঘাটতি রয়েছে। কোথাও কর্তৃপক্ষ কিংবা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করতে দেখিনি।'

রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী জানান, 'তেলের দাম বাড়ার পর থেকে আমরা যারা শিক্ষার্থী, তাদের ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে। হাফ ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা হাফ ভাড়া না নিয়ে বেশি ভাড়া দাবি করছে।'

বিভিন্ন কোম্পানির বাসে এখনো চলছে 'ওয়েবিল সিস্টেম'। আর ওয়েবিলের কথা বলেও অনেকে অতিরিক্ত ভাড়া চাইছেন। মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুলাহপুরগামী প্রজাপতি গাড়িতে কলেজগেট যাচ্ছিলেন নাইমা আখতার। তার সঙ্গে আসাদগেট এলাকায় বাগ্‌বিতন্ডা হয়েছে বাসের হেলপারের। তিনি ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে বাসভাড়া দাবি করছেন ১৫ টাকা। ওই যাত্রী বলেন, 'যতটুকু পথ যাত্রী তার দূরত্ব দুই কিলোমিটারেরও একটু বেশি। প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবেও ভাড়া ৫-৬ টাকার বেশি না। সর্বনিম্ন ভাড়া হিসেবে ১০ টাকা নিতে পারে। অথচ নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। এটা এক প্রকার জুলুম।' এ বিষয়ে হেলপারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে শুধু বলেন, 'ভাড়া বেড়েছে।'

'রবরব পরিবহণের' হেলপার শাজাহান উল্টো যাত্রীদের ওপর দোষ চাপান। তিনি বলেন, 'ভাড়া বেড়েছে। আমরা হিসাব করে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নিচ্ছি। কিন্তু যাত্রীদের সাথে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীরা গায়ে হাত তুলছেন।' এখনো ভাড়ার চার্ট তারা পাননি বলে দাবি করেন।

এদিকে, বিআরটিএর পক্ষ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি তদারকির জন্য গাবতলীতে পরিচালিত হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। আদালত-১০ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জুবের আলম বলেন, 'আমরা মাঠে রয়েছি। যাত্রীদের বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।'

আদালত-৩ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদুল হাসান রাজধানী বনানী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। এর আগে তিনি মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, 'সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন আমরা সে ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে