মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পুরনো সিন্ডিকেটের নতুন কারসাজি

দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পর বাজারে সয়াবিন তেল উধাও হ মজুতে তৎপর আমদানিকারক, মিল মালিক, ব্যবসায়ীরা হ ডিও পেয়েও ৩ দিন ধরে সরবরাহে ব্যাপক গড়িমসি হ অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান
সাখাওয়াত হোসেন
  ১১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই দেশের চাল-ডালসহ সব ধরনের খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এ বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এই সুযোগে দেশের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ভোজ্যতেলের বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টির টার্গেট নিয়ে তারা নানা কারসাজিতে মেতেছেন। বাজার পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, সরবরাহ কমিয়ে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সেই পুরনো সিন্ডিকেট ফের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর ডলারের দাম ও পরিবহণ খরচ বাড়ার অজুহাতে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজার থেকে হাজার হাজার টন তেল উধাও হয়ে গেছে। মিল মালিকরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ডিও নেওয়া একরকম বন্ধ করে দিয়েছেন। কোনো কোনো কোম্পানি ডিও নিলেও মাল সরবরাহে গড়িমসি করছে। ফলে সোমবার থেকেই খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের টান পড়েছে। পাড়া-মহলস্নার মুদি দোকান ও স্থানীয় বাজারের বড় দোকানগুলোতে ক'দিন আগেও ডজন ডজন সয়াবিন তেলের বোতল সাজানো দেখা গেলেও সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে।

বাজার পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই। এ ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, এটা ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে। অর্থাৎ সাপস্নাই চেইনে কিছুটা কনজারভেটিভ হয়ে গেছে। আমদানিকারক, মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা সাপস্নাইটা ঠিকভাবে দিচ্ছেন না। তাতে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে একটা আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে।

সরেজমিন রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, সবুজবাগ ও হাতিরপুলসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজার এবং পাড়া-মহলস্নার অর্ধশতাধিক দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানেই ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। কিছু দোকানে স্বল্প পরিমাণ সয়াবিন তেল থাকলেও তারা শুধু নিয়মিত কাস্টমারদের কাছে তা বিক্রি করছেন। যদিও তাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।

বাজারে সয়াবিন তেলের আকস্মিক সংকটের কারণ খুঁজতে দোকানিদের সঙ্গে

কথা বলে জানা যায়, এর আভাস তারা আগেই পেয়েছেন। মালিবাগ বাজারের সোহান জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মুজিবুল হক বলেন, 'কয়েকদিন ধরে কোম্পানির লোকেরা এসে বলে যাচ্ছেন সয়াবিন তেলের দাম আবারও বাড়বে। তারা আগে থেকে যখনই এ ধরনের সিগন্যাল দেন তখনই আমরা বুঝতে পারি বাজারে কোম্পানিগুলো তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এ কৌশল অবলম্বন করে আসছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোম্পানির লোকেরা যেদিন দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছে, তার পরের দিন থেকেই বাজারে তেলের সাপস্নাই অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।

এই দোকানির দাবি, কোম্পানির লোকজনের ইশারা পেয়ে অনেকে শত শত লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি না করে দোকান থেকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ বাজার থেকে তেল কিনে অবৈধভাবে মজুত করেছেন। তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর তারা তা বিক্রি করে হাজার হাজার টাকা কামাবেন।

তবে শুধু খুচরা বা পাইকারি দোকানিরাই নয়, মিল মালিক, আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীদের কব্জাতেও বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল রয়েছে বলে মনে করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকেই তারা মাল ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষেত্রে অযথা কালক্ষেপণ করছেন। মাল স্টকে থাকলে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাজারে ছাড়লে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত লাভ পাওয়া যাবে এ আশায় তারা প্রতীক্ষা করছেন। গতবারের মতো এবারও সারা দেশে অভিযান চালানো হলে বিপুল পরিমাণ তেলের অবৈধ মজুত পাওয়া যাবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তবে বিগত সময়ের মতো মূল সিন্ডিকেটের টিকি ছোঁয়া না গেলে তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এ চক্র হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে কামিয়ে নেবে বলে মনে করেন তারা।

তবে মিল মালিক, আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীরা বাজার পর্যবেক্ষকদের এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের দাবি, দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে সে ধরনের কোনো সিন্ডিকেট নেই। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা তেলের দাম বাড়াতে চাচ্ছে। বিদেশ থেকে আগে আনা তেল তারা সরকার নির্ধারিত দরেই বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে তাদের দর বাড়াতে হচ্ছে। তা না হলে ব্যবসায়ীদের লোকসানে পড়তে হবে।

ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি টি কে গ্রম্নপের পরিচালক (ফাইন্যান্স ও অপারেশন) সফিউল আথহার তাসলিম যায়যায়দিনকে বলেন, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে দেশের বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তাই সরবরাহ ঠিক রাখতে দাম সমন্বয় জরুরি।

তিনি বলেন, 'আমরা যখন এলসি খুলেছি তখন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, এখন ডলারের দাম ১১২ থেকে ১১৫ টাকা। এটার ইনক্রিজ হয়েছে ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে তেলের দাম কমানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া ডিজেলের দাম বাড়ায় ইতোমধ্যে যারা ট্রান্সপোর্ট করে তারা আমাদের ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়াতে বলছেন।'

সফিউল আথহারের ভাষ্য, 'আমদানি ও পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে বলে আমরা নতুন প্রস্তাব দিয়েছি। এখন সরকার বিবেচনা করবে। আমরা কত দামে আমদানি করেছি, ডলারের দাম কত পড়েছে, বিশ্ববাজারে দর কত- এসব বিবেচনা করে সরকারের যদি মনে হয় দাম বাড়ানো উচিত, তাহলে বাড়াবে। কমানোর সুযোগ থাকলে কমাবে।' দাম নিয়ে ১৫ দিন পরপর পর্যালোচনা সভা হওয়া উচিত। তবে সেটা হচ্ছে না- যোগ করেন তিনি।

তবে এ প্রসঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, এর আগে ভোজ্যতেলের দাম যখন সমন্বয় করা হয়, তখন ডলারের দাম বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববাজারে দাম যতটা কমেছিল, দেশে সে অনুযায়ী দাম কমেনি। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাব পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে মাথায় রাখতে হবে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ চাপে রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় চাপ আরও বাড়বে।

প্রসঙ্গত, এবার দেশে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাব ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) দিয়েছে সংগঠনটি। এতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা, এক লিটারের বোতল ২০৫ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৬০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, সয়াবিন তেল আমদানিতে সরকার ভ্যাট কমিয়েছে, ভ্যাট কমানোর পর কী পরিমাণে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা আমদানি করছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির পর মূল্য কত পড়ছে- সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে তারপর সয়াবিন তেলের দাম পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। তবে এর আগেই বাজারে অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টা সত্যিই দুঃখজনক।

শফিকুজ্জামান বলেন, 'যারা পাইকারি ব্যবসায়ী তারাই মূলত কারসাজি করে সয়াবিন তেলের সংকট সৃষ্টি করছেন। বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ জন্য শিগগিরই আবারও ভোজ্যতেলের বাজারে অভিযান জোরদার করা হবে।'

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ভোজ্যতেলের বাজারে কড়া নজরদারি রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ভোজ্যতেলের বাজার টালমাটাল হওয়ার কারণ খুঁজতে শিগগিরই মাঠে নামবে। এ জন্য মহলস্নার মুদি দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় বাজারের মুদি দোকান, পাইকারি ব্যবসায়ী, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজারের এসও (সেলস অর্ডার) ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষ মিল পর্যায়ে অনুসন্ধান চালানো হবে। ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশের শীর্ষ ৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রম্নপ, টি কে গ্রম্নপ, এস আলম গ্রম্নপ, মেঘনা গ্রম্নপ ও শবনম অয়েলসহ আরও একটি প্রতিষ্ঠানের মজুতের তথ্য পর্যালোচনা করবে সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বিগত সময় সয়াবিনের বাজারে অভিযানে নেমে দেখা গেছে সবচেয়ে বড় ঘাপলা হয় মিল পর্যায়ে। এরপর সিন্ডিকেট করে এসও ব্যবসায়ীরা। মিল পর্যায়ে ঘাপলা হয় কয়েকটি ধাপে। মিল মালিকরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কী দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করেন সে মূল্য উলেস্নখ করে না। এটি না থাকায় তারা কত টাকায় আমদানি করে, রিফাইন ব্যয় কত- সব মিলিয়ে তাদের খরচ কত হয় আর কী দামে বিক্রি করার কথা- সেটি বোঝা যায় না। এই সুযোগটি নেন এসও ব্যবসায়ী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় ঘাপলা। এ জন্য মিল মালিকদের বলা হয়েছে, বিক্রির সময় অবশ্যই পাকা রসিদ ব্যবহার করতে। কত টাকায় কিনলেন এবং কত টাকায় বিক্রি করলেন সেটি পরিষ্কারভাবে রসিদে উলেস্নখ থাকতে হবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মানা হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, 'মিল মালিকরা ছাড়াও এসও ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী এবং খুচরা পর্যায়ে এসেও অনেক সময় কারসাজি হয়। এভাবে একেক ধাপের কারসাজির কারণেও অনেক দাম বেড়ে যায় ভোজ্যতেলের। আমরা এই সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে