ত্রম্নটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি

সিপিডি'র সংলাপে বক্তারা

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি রিপোর্ট
সিপিডি'র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ত্রম্নটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে আসা উচিত। ভোক্তার ওপরে দায় না চাপিয়েও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেত। বুধবার ধানমন্ডিতে সিপিডি'র কার্যালয়ে আয়োজিত সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। মোয়াজ্জেম বলেন, অবশ্যই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এড়ানো যেত। সংকট এড়ানো যেত, মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ত না। বিপিসি যদি তার হিসাবে স্বচ্ছতা রাখত, তাহলে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব সমন্বয় করা যেত। বিপিসি কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে, সে হিসাব জনগণের সামনে আসা দরকার। তিনি আরও বলেন, সাবসিডি ম্যানেজমেন্টের নামে মূল্য বৃদ্ধি না করে, অব্যবহৃত অর্থ দিয়ে সাবসিডি অ্যাডজাস্ট করা যায়। আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ওই কৌশল নেওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে ভোক্তার ওপর দায় চাপানো ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, গত ৬ বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? বলা হয়েছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে সেটা জানা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সূত্রে যে খতিয়ান দেখতে পাই, তাতে নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পেয়েছি। সেখানে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে মাত্র ৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ আছে। তাহলে বিপিসির টাকা কোথায়? আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তাহলে ওই টাকা কোন টাকা? এছাড়াও বাকি টাকা কোথায়? আমার ধারণা বাকি টাকাও বিপিসির হিসাবেই রয়েছে। তাহলে কেন লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো। চলতি অর্থবছরেও ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বিপিসি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এ বছরেও বিপিসি বিনিয়োগ করবে! জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে? এদিকে, 'জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?' শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিপিসি ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল ও পাকিস্তানের বেশি। এখানে মনে রাখতে হবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতেই হবে। দাম কাদের চেয়ে বেশি, সিঙ্গাপুর, হংকং ও জার্মানির চেয়ে বেশি আছে। যাদের মাথাপিছু আয় ৫০ হাজার ডলারের কাছাকাছি তাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখন তুলনা করব তখন সে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপট মাথায় রাখা জরুরি। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে প্রথমেই পরিবহণ সেক্টরের ভাড়া বৃদ্ধি পায়, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দেবে, ফলে আমদানি আবার বেড়ে যাবে। শিল্পের উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে। তাহলে ব্যবসার লভ্যাংশ কমে যাবে। তারপরও বিদু্যৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ধাপে ধাপে খরচ বৃদ্ধিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করবে। যার প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রায়। এর বড় ধাক্কা আসবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ওপর। সঞ্চয় ভেঙে খাবে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সুদের হার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখান থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, মূল্য পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমরা নিম্নমুখী সামঞ্জস্যতার কথা বলছি। এর পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি ও রেশনিং কার্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে আবার ব্যয় করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেওয়া হয়েছে, অনেকেই তা নিতে পারেনি। তাদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে। বড় বড় ব্যবসায়ীদের বার বার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ছোটদের জন্য বাস্তবে কিছু করা হচ্ছে না। সংলাপে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেছেন, বর্তমানে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই আমরা নানা সমস্যায় আছি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। অনেক শ্রমিক খরচ মেটাতে পারবে না, তারা গ্রামে চলে যাবে। এতে আমাদের শিল্প বন্ধ হবে। তিনি বলেন, ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিক বিপদে পড়বে। নিত্যপণের দাম বাড়লে পোশাক শ্রমিক কাজে মন দিতে পারবে না। দাম বৃদ্ধির কারণে ডিজেল দিয়ে শিল্প চালু রাখা ফিজিবল না। এক্সপোর্ট পজিশন ভালো না। এখন ডলার ক্রাইসিস। আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ বায়ারের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারছি না। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। শ্রমিক গ্রামে চলে যাবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অফিস যাতায়াতে ভাড়া দুই হাজার ১০০ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তেলের দাম ও গাড়ি ভাড়া বাড়ানোর পর অফিসগামী যাত্রীদের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, যারা কর্মজীবী-শ্রমজীবী আছেন, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেতনে যাতায়াত ভাড়া দেওয়া হয় না। আমরা বেশকিছু চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। যারা বেতন পান সর্বনিম্ন তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমরা দুদিনে ২৮টি বাস কাউন্টারে পর্যবেক্ষণ করেছি। অফিসগামীদের প্রতিদিন যাতায়াতে বাসভাড়া সর্বনিম্ন ৭০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যার পরিমাণ দুই হাজার ১০০ থেকে ছয় হাজার। যার বেতন তিন হাজার ২০০ টাকা, তিনি দুই হাজার ১০০ টাকা ভাড়া দেবেন কীভাবে? মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, 'একজন চাকরিজীবীর সঙ্গে আমি কথা বললাম, যিনি বেতন পান ১০ হাজার টাকা। দোকানে চাকরি করেন। তার স্ত্রীও চাকরি করেন। ঢাকায় সাবলেট থাকতেন। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি গ্রামে চলে যাবেন। কারণ তার প্রতিদিন ৭০ টাকা গাড়ি ভাড়া ধরে মাসে দুই হাজার ১০০ টাকা ভাড়া বেড়েছে। মাসে চারবার বাড়িতে যান এমন অনেক চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের চারবারের যাতায়াতে অনেকের এক হাজার আবার অনেকের চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।' অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক ও জ্বালানি টেকসই এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ডক্টর ইজাজ হোসেন।