বাঙালির কান্নার দিন আজ

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১০:২১

যাযাদি রিপোর্ট

'এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি কাঁদো/ জানি, দীর্ঘদিন কান্নার অধিকারহীন ছিলে তুমি/ হে ভাগ্যহত বাংলার মানুষ, আমি জানি/ একুশ বছর তুমি কাঁদতে পারোনি। আজ কাঁদো/ আজ প্রাণ ভরে কাঁদো, এসেছে কান্নার দিন/ দীর্ঘ দুই-দশকের জমানো শোকের ঋণ/ আজ শোধ করো অনন্ত ক্রন্দনে'- কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় শোকাবহ বাঙালির কান্নার যে দিনটির কথা বলেছিলেন আজ সেই বেদনাবিধূর ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার সেই ভয়াল দিন। বাংলার মহানায়কের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী। আজ জাতীয় শোক দিবস। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল বিপথগামী একদল সেনাসদস্য। ভোরের আলো ফোটার আগেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল এবং বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। সেই কালরাতে আরও প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণিসহ বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে গিয়ে ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন তার সামরিক সচিব জামিল উদ্দীন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতাবিরোধী চক্র রাষ্ট্রক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে সংগ্রামী বীর বাঙালিকে হায়েনার দল অস্ত্রের মুখে দমিয়ে রাখতে চায় পাকিস্তানি হানাদারদের মতোই। ঘাতকচক্র ও তাদের দোসররা বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিয়ে দেশকে আবারও পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। খুনিচক্রের প্রধান দোসর জাতীয় বেইমান 'বাংলার মীরজাফর' খন্দকার মোশতাক ও তার সরকারে থাকা সঙ্গীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে ও খুনিদের রক্ষা করতে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করে। পরবর্তীতে অনৈতিক পন্থায় ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। শুধু তাই নয়, জিয়া সরকার খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া সরকার খুনি কর্নেল রশীদকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি দেয়। হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' বাতিল করলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর এই জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচারকাজ শুরু হয়। প্রায় ৩৫ বছর পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি জাতির পিতা হত্যার কলঙ্কতিলক থেকে জাতি মুক্তি পায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসির মাধ্যমে মৃতু্যদন্ডের রায় কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল মধ্যরাতে খুনি মাজেদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর আরও ৫ খুনি এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থান এখনো শনাক্ত করা যায়নি। দুজনের অবস্থান বিদেশে শনাক্ত হলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে চলমান আলোচনায় এখনো কোনো সুফল আসেনি। পলাতক আসামিরা হলেন-আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। তাদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা আছে। এদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন সংস্থা। বাকিরা কোথায় আছে সেটা নিশ্চিতভাবে কারো জানা নেই। এদের কারো বর্তমান মুখাবয়ব নিশ্চিত নয় কেউই। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। এবারও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটি। আজ সরকারি ছুটি। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার জাতীয় শোক দিবসে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসহ সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সোমবার সকাল ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের সদস্য ও অন্য শহীদদের কবরে প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক ও ফুলের পাপড়ি অর্পণের পর ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এদিন সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান ছাড়াও সমাধি কমপেস্নক্সে ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করা হবে। শোক দিবসে সারাদেশের মসজিদগুলোতে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। এছাড়া শোক দিবস উপলক্ষে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর পোস্টার প্রকাশ করেছে। সারাদেশে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে। তথ্য অধিদপ্তর বাংলাদেশ সচিবালয়ে সপ্তাহব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করবে। বিভাগীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক তথ্য অফিস আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। সব সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্র প্রদর্শনী, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবে। জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিলসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালিত হবে। অনুষ্ঠানগুলোতে সরকারি কর্মকর্তাদের আবশ্যিকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ শোক দিবসের নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। ধানমন্ডি, বনানী ও টুঙ্গিপাড়ার অনুষ্ঠান বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হবে। এছাড়া অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম বেতার ও কমিউনিটি রেডিও এ অনুষ্ঠানগুলো সরাসরি সম্প্রচার করবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এদিন দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। রোববার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা শায়লা শারমীন জানান, দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সোমবার বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে দোয়া ও মোনাজাতের জন্য দেশের সব মসজিদের খতিব, ইমাম ও মসজিদ কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আগামীকাল বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, ৫০টি ইসলামিক মিশন, ৭টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি ও মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের গণশিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। জি এম কাদেরের বাণী : জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, '১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী। আমরা এই শোকাবহ দিনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে শহীদ সকল সদস্যের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।' বাণীতে জি এম কাদের বলেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কর্মময় সংগ্রামী জীবনে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন আজীবন। দুর্নীতি, দুঃশাসন আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন উৎসাহ জোগাবে।' 'শোকাবহ এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার- ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটি কল্যাণময় রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবো' বলে বাণীতে বলেন জি এম কাদের।