'নিরাপদ ঢাকা' প্রকল্পের ধীরগতি

মনিটরিংয়ে প্রয়োজন ৪৯ হাজার সিসি ক্যামেরা ইতোমধ্যে সিসি ক্যামেরা বসেছে মাত্র ৬০০

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৬

গাফফার খান চৌধুরী

অর্থাভাবে ধীরগতিতে চলছে 'নিরাপদ ঢাকা' বা 'সেভ ঢাকা' প্রকল্পের কাজ। রাজধানীতে অপরাধ দমনে ২৬ বছর আগে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রযুক্তিগতভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে ৪৯ হাজার শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা। যা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসানোর কথা ছিল। প্রথম পর্যায়ে গুরুত্ব ও স্থান বিবেচনা করে ১৬ হাজার শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। হালনাগাদ পুরো ঢাকায় মাত্র ৬০০ সিসি ক্যামেরা বসেছে। বাকি ক্যামেরাগুলো অর্থাভাবে আর লাগানো হয়নি। পর্যায়ক্রমে সেগুলো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে লাগানো হবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে প্রথম ঢাকাকে 'নিরাপদ শহর' বা 'সেভ ঢাকা' ও যানজটমুক্ত শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই অংশ হিসেবে পুলিশের কন্ট্রোলরুম আধুনিক করার কাজ শুরু হয়। কন্ট্রোলরুম শাহবাগ থেকে সরিয়ে সচিবালয়ের সামনে নবাব আব্দুল গণি রোডে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে, সরকারি পরিবহণ পুল ও নগর ভবনের পাশে সর্বমোট ৫ একর জায়গা কন্ট্রোলরুম স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই সময়ই ১৪তলা আধুনিক ভবন নির্মাণের অনুমোদনসহ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ১৪তলা ভবনের নকশা অনুযায়ী ফাউন্ডেশন দিয়ে কাজও শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের উন্নয়ন শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র পাল্টে যায়। কন্ট্রোলরুম স্থাপনের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে ১৪তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ৬তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। 'নিরাপদ ঢাকা' গড়ার পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে যায়। শুরু হয় হাস্যকর কাজ-কর্ম। ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে লাগানো হয় মাত্র ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা। যা পরবর্তী সময়ে অচল হয়ে যায়। এই কর্মকর্তা বলেন, এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই একের পর ঢাকায় বড় ধরনের হামলা ও নাশকতার ঘটনা ঘটতে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা। রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনকে হত্যা ও পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। লগি-বৈঠা দিয়ে হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই কর্মকর্তা বলেন, মূলত রাজনৈতিকসহ সব ধরনের অপরাধ দমনে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের পরিকল্পনা মোতাবেক ঢাকার বহুতল ভবনসহ যেসব জায়গায় রাজনৈতিক বা বিভিন্ন সমাবেশ বা মিছিল হয়, সেসব জায়গায় শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা ছিল। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে হয়তো এতসব ভয়াবহ হামলা বা নাশকতার ঘটনা নাও ঘটতে পারত। হামলায় জড়িত এখনো অনেককেই উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আইনের আওতায় আনা যায়নি, তাদের নিশ্চিতভাবে আইনের আওতায় আনা যেত। এমন মারাত্মক ওইসব নাশকতামূলক ঘটনার আরও অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব ছিল। এমনকি ঘটনার আগেই হামলাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল। হামলা ঠেকানো সম্ভব না হলেও হামলাকারীদের দ্রম্নত গ্রেপ্তারের আওতায় আনা যেত। জড়িতদের গ্রেপ্তারে এত বেগ পেতে হতো না। পুলিশ সদর দপ্তরের উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রকল্পটি চালু করার বিষয়টি আলোচিত হয়। নতুন করে প্রকল্পের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে 'ভেডেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম'। প্রকল্পের শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সূত্রটি জানায়, প্রকল্পটি নিয়ে ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স ও অ্যাপস্নাইড ফিজিক্স বিভাগ, বিটিসিএল (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করা হয়েছে। ঢাকা সার্ভে করে ৪৯ হাজার সিসি ও মুভি ক্যামেরা লাগানোর প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৬ হাজার ক্যামেরা বসানোর কথা। পুলিশ সদর দপ্তরের ডেডেলপমেন্ট শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ক্যামেরাগুলো অপটিক্যাল ফাইবারের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যা যানজট নিরসনে আগাম সংকেত, পুলিশের সুনির্দিষ্ট অবস্থান, সন্দেহভাজন বস্তু ও ব্যক্তি শনাক্তকরণে আগাম সংকেত দেবে। পাশাপাশি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে আসা ফোন নম্বরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাহিদা মোতাবেক সেই সেই সেলে চলে যাবে। বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ জরুরি সেবা পেতে ফোন করে। এসব ফোন তাৎক্ষণিক জেলা পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও ফায়ার সার্ভিসের কাছে চলে যাবে। তিনি আরও জানান, অপরাধে ব্যবহৃত গাড়ি ও অপরাধী শনাক্তে সংকেত দেবে, যানবাহনের নম্বরপেস্নট শনাক্ত করা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের শনাক্ত করা, কোন সড়কে কত গাড়ি রয়েছে, সে সম্পর্কে আগাম বার্তা দেবে। পুলিশের প্রতিটি শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই সিস্টেমটি। ফলে কে কী কাজ করছে, তা কন্ট্রোলরুম থেকে দেখা যাবে। ওই কর্মকর্তা জানান, প্রস্তাবিত ক্যামেরাগুলো যুক্ত থাকবে পুলিশ গেস্নাবাল ইনফরমেশন সিস্টেমের সঙ্গে। যা কোনো জায়গা বা বস্তু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেবে। ফলে কোনো ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাৎক্ষণিক সেই জায়গায় চলে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন পুলিশ সদস্যের জায়গাটি কোথায় বা কীভাবে যাবেন সে সম্পর্কে আগাম ধারণা না থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের ডেভেলপমেন্ট শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোশারফ হোসেন বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, প্রকল্প নানা জটিলতার কারণে ঝুলে আছে। আশা করছি দেশবাসীর সেবা পেতে পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার এ বিষয়ে নজর দেবে। পুলিশ সদর দপ্তরের উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক জানান, ঢাকায় দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। সশরীরে উপস্থিত থেকে এত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তত ২ থেকে ৩ লাখ পুলিশের প্রয়োজন। দেশের বাস্তবতায় তা সম্ভব নয়। এজন্য প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। হালে অপরাধের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। অপরাধীরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এজন্য প্রযুক্তি ছাড়া অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের নেওয়া সুদূরপ্রসারী দূরদর্শী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জরুরি। সিসি ক্যামেরা ছাড়াও মুভি ক্যামেরাও বসানোর কথা উঁচু ভবনগুলোতে। প্রযুক্তির এই সুবিধা যুগ যুগ ধরে দেশবাসী পাবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন 'সেভ ঢাকা' বা 'নিরাপদ ঢাকা' গড়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ চলমান আছে। প্রকল্পটি একবারে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। তাই আমরা গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিবেচনা করে প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছি। ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, অপরাধ কমিয়ে আনতে এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পর্যায়ক্রমে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রকল্পটির আওতায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ চলছে। তবে একবারে নয়, পর্যায়ক্রমে। প্রকল্পটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে ঢাকা শহরবাসী উপকৃত হবে।