গার্ডার তোলার ক্রেন চালাচ্ছিলেন হেলপার

উত্তরায় গার্ডার চাপায় মৃতু্য অভিযুক্ত ১০ জন গ্রেপ্তার হ শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় আপত্তি নেই চীনের হ ক্রেনের সক্ষমতার চেয়ে গার্ডারের ওজন বেশি

প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি রিপোর্ট
উত্তরায় গার্ডার চাপায় ৫ জনের মৃতু্যর ঘটনায় ক্রেনের মূল চালক আল আমিনের হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল না। ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ৩ মাস আগে প্রকল্পের হেলপার হিসেবে কাজে যোগ দেন গ্রেপ্তার রাকিব। তার ক্রেন চালনার কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার ঘটার আগে রাকিব ক্রেন চালাচ্ছিলেন। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ২০ টন ওজনের গার্ডার উত্তোলনের সময় ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারালে গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর ছিটকে পড়ে। এ সময় গার্ডারের চাপায় পিষ্ঠ হয়ে প্রাইভেট কারের ৫ যাত্রী নিহত হন। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। এদিকে উত্তরায় গার্ডার চাপায় ৫ জন নিহতের ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিচালক জানান,র্ যাবের কয়েকটি দল সমন্বিতভাবে সোমবার রাতে পৃথক অভিযান চালিয়ে রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালসি, সাভার, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন- ক্রেনচালক মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫), হেলপার রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), ভি ইকু্যইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিক মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) এবং মো. মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)। কমান্ডার খন্দকার মঈন বলেন, শুধু অপারেটর-চালককে ধরেছি তা নয়। যে ক্রেন সরবরাহ করেছে, কিনেছে তাদেরও ধরা হয়েছে। এখানে একটি কমিটি কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে যাদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছি, তাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি। যাদের মনে করেছি, এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। আইন সবার জন্য সমান। অপরাধ করে এই সরকারের সময় কেউ পার পায়নি। এখানে তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট নিয়ে কাজ করছে, কনক্লুসিভ একটি রিপোর্ট হবে। তিনি জানান, এই দুর্ঘটনায় যাদের ইনভল্‌ভমেন্ট আসবে, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চাইনিজ গেজুবা গ্রম্নপ কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের কোন লেভেল পর্যন্ত এখানে জড়িত, কারা জড়িত, এসব বিষয় কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বেরিয়ে আসবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বা যে কার্যক্রম ছিল, স্টেপ বাই স্টেপ আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখানে আরও জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ আছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি হতে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান হতে অপারেটর ও হেলপারসহ ওই ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের মালিক গ্রেপ্তার ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়াও গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। র্ যাব জানায়, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লি. মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ওই ক্রেন সরবরাহ করে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেপ্তার তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ; ক্রেনগুলোর ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। রুহুল ২০১০ সালে এবং গ্রেপ্তার তুষার ২০১৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স ব্যতীত অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ দেয়। এছাড়া ওই ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। অন্যদিকে, ওই দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে চীনের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উলস্নাহ নুরীর সঙ্গে সাক্ষাতে এমন মতামত দেন চীনা রাষ্ট্রদূত। চীনা রাষ্ট্রদূত এ সময় প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। আহতদের দ্রম্নত আরোগ্য কামনা করে রাষ্ট্রদূত জানান, ঢাকা বিআরটি প্রকল্পের সওজ অংশের নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদন্তের জন্য চীন থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। প্রতিনিধি দলটি সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। এ সময় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সমগ্র জাতি ব্যথিত। যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিতে আমরা বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সময় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতার, বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম, প্রকল্পের পরামর্শক টিমের প্রধান টিগ ম্যাকরিন ও সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উলেস্নখ্য, ১৫ আগস্ট বিকালে উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেনে থাকা গার্ডার প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এ ঘটনাস্থলেই পাঁচ জনের মৃতু্য হয় এবং দু'জন গুরুতর আহত হন।