জনভোগান্তি চরমে

দেশজুড়ে হাড়কাঁপানো শীত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়

শৈত্যপ্রবাহ কয়েকদিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস হ বিপাকে শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল মানুষ হ জেলায় জেলায় শীতজনিত রোগের প্রকোপ

প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। এই শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। পৌষের মাঝামাঝি এসে টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কমায় শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে। দিনের অল্প যেটুকু সময় কুয়াশা ভেঙে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়, তার বাইরে সারা দিনই গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে থাকতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা কমছে। সেইসঙ্গে উত্তর থেকে ছুটে আসছে হিমেল হাওয়া। এরই প্রভাবে হাড়কাঁপানো শীতে দেশজুড়ে জনভোগান্তি চরমে উঠেছে। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ থেকে ১৬ ডিগ্রির মধ্যেই ছিল। দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে সারা দেশেই অনুভূত হচ্ছে তীব্র শীত। কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিম বাতাসে নাকাল হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে। হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর ভিড়। সকাল সকাল কাঁপতে কাঁপতে স্কুলমুখী হচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরা। নগরীর শ্রমজীবী আর পেশাজীবীরাও গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে ছুটছেন গন্তব্যে। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থায় বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলেও পূর্বাভাসে উলেস্নখ করা হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- স্টাফ রিপোর্টার চুয়াডাঙ্গা জানান, শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় কনকনে শীত, ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জেলার জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশা। হেডলাইট জ্বালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেছে যানবাহন। হিম বাতাসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ আর ছিন্নমূল মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকে। শুক্রবার সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তীব্র শীতে জবুথবু চুয়াডাঙ্গায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ। সোমবার থেকে টানা দিনদিন সূর্যের দেখা মেলেনি। আজ শনিবার সূর্যের দেখা নাও মিলতে পারে বলে জানিয়েছে চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস। জেলা ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে গতকাল পর্যন্ত ২১ হাজার ১শ' পিচ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা ১ আসনের এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার ২ হাজার ৮৮৮ পিচ কম্বল কেনা হয়েছে। যেগুলো বিতরণের কাজ চলছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, 'এ জেলায় যে পরিমাণ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে তা চাহিদা তুলনায় অপ্রতুল। আরো শীতবস্ত্র চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে।' শীতজনিত কারণে হাসপাতালে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। শীতবাহিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে ১৩টি বেডের বিপরীতে ভর্তি রয়েছে ৫০ জন। অপরদিকে প্রতিদিন ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি হচ্ছে শতাধিক। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাদ বলেন, 'হাসপাতালে শয্যা সংকট। তবে পর্যাপ্ত স্যালাইন ওষুধ আছে। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে এই তীব্র শীতে সবাইকে একটু সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের একটু বাড়তি যত্ন নিতে হবে। সব সময় শীতের পোশাক পরিধান করে থাকতে হবে। সমস্যা হলেই নিকটস্থ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে আসতে হবে।' কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতে কুড়িগ্রামের জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের মিলপাড়া এলাকার বেলাল হোসেন বলেন, 'এই শীতে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছি। শীতকালে ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় সংসার চালানোয় কঠিন হয়ে পড়েছে। অভাবের সংসার ছেলেদের জন্য শীতের কাপড় কিনব তাও পারছি না।' সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বাতেন সরকার বলেন, 'এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৫শ কম্বল বরাদ্দ পাইছি তা বিতরণ করা হয়েছে। কয়েকদিন থেকে তীব্র শীত পড়ছে। অনেক মানুষ কম্বলের জন্য আসছে, পর্যাপ্ত না থাকায় সবাইকে দিতে পারছি না। মানুষজন কম্বলের জন্য পাগল হয়ে আছে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের দানশীল মানুষজন এগিয়ে এলে হয়তো অসহায় মানুষগুলোর অনেক উপকার হতো।' \হজেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৯ উপজেলায় ৩৮ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যা বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তুহিন মিয়া বলেন, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা আরও কমে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। রাজবাড়ি প্রতিনিধি জানান, ঘন কুয়াশায় দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে কুয়াশার ঘনত্ব কমে এলে এই নৌপথে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। এর আগে কুয়াশার তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, টানা দুই সপ্তাহ ধরে ঘন কুয়াশায় রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। গত ১৫ দিনে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে প্রায় ৮০ ঘণ্টা ফেরি বন্ধ ছিল। ঘন কুয়াশায় প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে ফেরি বন্ধ থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রী ও যানবাহন চালকদের। বিআইডবিস্নউটিসি দৌলতদিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক আলিম রায়হান বলেন, 'ঘন কুয়াশায় ভোর সাড়ে ৫টা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কুয়াশা কেটে গেলে আড়াই ঘণ্টা পর সকাল ৮টা থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। বর্তমানে এই নৌপথে ১২টি ফেরি চলাচল করছে। পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, মৃদু শৈত্যপ্রবাহে নাজেহাল পরিস্থিতিতে পড়েছেন উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের মানুষ। তাপমাত্রা আরও কমে শুক্রবার সকালে রেকর্ড হয়েছে ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবারের চেয়ে তাপমাত্রা কমেছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা এক সপ্তাহজুড়ে শীতল বাতাস আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বিপাকে পঞ্চগড়ের মানুষ। রাত ৮-৯টার মধ্যে শহরের হাটবাজারগুলোতে কমে যায় কোলাহল। ভোর থেকেই বেলা অবধি ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকছে জেলার চারপাশ। কুয়াশার কারণে মধ্যরাত থেকে বেলা বাড়া পর্যন্ত সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বিভিন্ন যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী ও কর্মজীবীরা। সকালে সূর্যের দেখা মিলছে না। হাটবাজারে কাগজ, টিউব পুড়িয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে অনেককে। নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন ফুটপাতের দোকান গরম কাপড় কিনছে। স্থানীয়রা জানান, হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দুই পর্বতশৃঙ্গ নিকটে হওয়ায় এই জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। বিকাল গড়ালেই উত্তর-পূর্বকোণ থেকে বইতে থাকে ঠান্ডা বাতাস। সন্ধ্যার পর বাতাসের সঙ্গে ঝরতে থাকে বরফের মতো ঠান্ডা। এই সময়টাতে মাত্রা অতিরিক্ত শীত অনুভূত হয়। রাতে কম্বল ও লেপ নিলেও বিছানা বরফের মতো লাগে। চা-শ্রমিক জাহেরুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন, আরশেদ ও আরিফ বলেন, দুদিন ধরে কুয়াশা না থাকলেও মেঘলা পরিবেশ রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় ঠান্ডা বাতাস। এ বাতাসের কারণে শীতের মাত্রা বেড়ে যায়। রাতে মনে হয় তাপমাত্রা জিরোতে চলে আসছে। চা বাগানে কাজ করতে গেলে হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে কাজে বের হতে হয় আমাদের। কবির হোসেন ও হুমায়ুন কবির নামে দুই ফ্রিল্যান্সার বলেন, 'রাতটা বরফ হয়ে উঠে। তাপমাত্রা যেন শূন্যে চলে আসে। আমাদের রাতে বসে কাজ করতে হয়। কিন্তু শীতের তীব্রতার কারণে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।' এদিকে শীতের প্রকোপে বেড়েছে নানা ঠান্ডাজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, শৈত্যপ্রবাহের ফলে মেহেরপুরে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। কয়েকদিন জেলার কোথাও সূর্যের দেখা মেলেনি, ফলে কমছে না শীতের তীব্রতা। জেলার গড় তাপমাত্রা ৯ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তীব্র শীতে সব চাইতে বেশি বিপাকে পড়েছে ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষ। সাধারণ মানুষ একান্ত কাজ ছাড়া সহসাই কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। প্রতিদিনের আয়ে ভাটা পড়েছে তাদের। চাষীরা জানান, শীতের কারণে মাঠের কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এখন শীতকালীন সবজির সময়। এ সময় মাঠে সবজি উঠানো বাজারে নেওয়া পরিচর্যা করার নানান কাজ থাকে। শীতের তীব্রতায় এসব কাজে বিঘ্ন হচ্ছে। এদিকে হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। কয়েকদিনে শতাধিক শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এতে হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ অঞ্চলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহ চলছে। এ অবস্থা আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। শুক্রবার সকালে মেহেরপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৭ ডিগ্রি সেলিসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।