দিন যেমন, সুদের হার তেমন

নিয়ন্ত্রণহীন কলমানি রেট

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

পবন আহমেদ
ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ নগদ অর্থের চাহিদা বেড়েছে। তাই কলমানি (স্বল্প সময়ের ঋণ) থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা ধার নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কলমানির ওপর নির্ধারিত সুদের রেট না থাকায় এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যে যার মতো করে কলমানি ঋণের সুদ হার নির্ধারণ করছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে কলমানি মার্কেট। সুদ নির্ধারণ হচ্ছে প্রতিদিনের ওপর নির্ভর করে। দিন যেমন সুদের হার তেমন। একদিনের জন্য ঋণ নিলে ৬.৮৭ শতাংশ, তিন দিনের জন্য ৬.৯৭ শতাংশ, সাত দিনের জন্য ৭.২৫ শতাংশ এবং ১৫ দিনের জন্য ১০ শতাংশ দিতে হচ্ছে। বুধবার এ খাতে সুদের হার ছিল ৬.৮৭ শতাংশ, আগের দিন এই হার ছিল ৬.৭০ শতাংশ, যা এক মাসে তিন গুণ বেড়েছে। আগের বছর একই সময়ে কলমানি রেট ২.৭২ শতাংশ ছিল। কলমানিতে বিভিন্ন মেয়াদে ধার দেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ধার দেওয়া হয় এক দিনের মেয়াদে। জানা গেছে, ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের উৎসে ভাটা পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে এলসির দায় পরিশোধ করা, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিও একটি কারণ। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করার কারণে চলতি অর্থবছরে দেশের বাজার থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। আবার ডিপোজিটের তুলনায় প্রাইভেট সেক্টরে ক্রেডিট গ্রোথ অনেক বেশি থাকায় টাকার চাহিদা বেড়েছে। লিকুইডিটি স্ট্রেসে থাকায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার করাও বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধিসহ নানামুখী প্রভাবে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানি চলছে। এ কারণে সুদের হার বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংক আমানতে সর্বনিম্ন সুদ হার বেঁধে দেওয়ার পর অনেক ব্যাংক আমানতের বিপরীতে সুদ দিতে পারছে না। একইসঙ্গে অনেক ব্যাংকের আমানত কমে এলেও ঋণের পরিমাণ কমছে না। \হঅথচ ব্যাংকগুলোকে আমানত ও ঋণের বিপরীতে এডিআর (ঋণ আমানতের অনুপাত) ও এসএলআর (অর্থ বিধিবদ্ধ জমা) সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। সে কারণে ব্যাংকগুলো মানি মার্কেটের ওপর নির্ভর করায় এর রেট হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে ঋণের বিপরীতে ১৩ শতাংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সে টাকা সংগ্রহ করতে মানি মার্কেটে ঝোঁকায় রেট বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, মঙ্গলবার এক দিনের জন্য কলমানি বাজার থেকে ৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ধার নিয়েছে ৬২টি ব্যাংক। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে টাকা ধার নিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদেও ধার পেয়েছে। তবে যেসব ব্যাংক কলমানি থেকে ১৪ দিনের জন্য টাকা ধার করেছে, তাদের সুদ গুনতে হয়েছে আরও ১০ শতাংশ বেশি। এই হারে ১৫ কোটি টাকা ধার করেছে একটি ব্যাংক। সোমবার এক দিনের জন্য কলমানি বাজার থেকে প্রায় ৪ হাজার ৪১১ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এর গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। রোববার কলমানি বাজার থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো কল মানিতে কেমন সুদে টাকা ধার দেবে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিখিত কোনো নির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কলমানিতে সুদের হার নির্ধারণ করে মৌখিকভাবে। এখানে রেপো রেটটিকে রেফারেন্স হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই রেটটিকেই কলমানিতে টাকা ধারের ম্যাক্সিমাম রেট হিসেবে রাখার জন্য বলে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো ওভারনাইট লোন দেওয়ার বদলে শর্ট নোটিশে ও টার্মে লোন দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ সুদের হার। নতুন কল মানি রেট তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না উলেস্নখ করে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমর্থন সত্ত্বেও, অনেক ব্যাংক তাদের তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যে কারণে ব্যাংক থেকে ব্যাংকের লোন নেওয়ার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক তাদের কাছ থেকে প্রায় সোয়া ৭ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা নিয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসেই নিয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। তারল্য সহায়তার পাশাপাশি রেপো সহায়তাও (পুনঃক্রয় চুক্তি) নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে তিনটিরই আমানতের পরিমাণ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংক প্রায় ৭ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা নিয়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া জনতা ব্যাংক নিয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক নিয়েছে ২ হাজার ৫১ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৫৩৩ কোটি টাকা নিয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক নিয়েছে ৫৪ কোটি টাকা। অবশ্য সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম বলেছেন, সোনালী ব্যাংকের কোনো তারল্য সংকট নেই। উল্টো সোনালী ব্যাংক কলমানিতে টাকা ধার দিয়ে আসছে।