বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু

'কহর দরিয়া' খ্যাত টঙ্গীর তুরাগ তীর লাখো মুসলিস্নতে পূর্ণ

২ মুসলিস্নর মৃতু্য

প্রকাশ | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
আজ ফজরের নামাজের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। 'কহর দরিয়া' খ্যাত গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমাস্থল এখন দেশি-বিদেশি মুসলিস্নদের আগমনে পরিপূর্ণ। পৌষের তীব্র শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে বাস-ট্রাক, কার-পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মুসলিস্নরা ইজতেমাস্থলের নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার লাখো মুসলিস্নর উপস্থিতিতে বাদ ফজর প্রাথমিক আম বয়ান অনুষ্ঠিত হয়। আজ ইজতেমার মূল কার্যক্রম শুরু হয়ে রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলবে তাবলিগের ৬ উসুলের এ বয়ান। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেমরা মূল বয়ান করবেন। মূল বয়ান বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষীদের জন্য তরজমা করা হয়ে থাকে। বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুন নূর জানান, দেশি-বিদেশি মুসলিস্নরা আসতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে মুসলিস্নতে পুরো ইতজেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে মূল পর্ব শুরু হলেও বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে শুরু হয় আম বয়ান। করোনার কারণে গত দুই বছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবার তাবলিগের এ মহাসম্মেলনে যোগ দিতে আগেভাগেই এবার মুসলিস্নরা মাঠে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। ময়দানে আসা মুসলিস্নদের জমিয়ে রাখতে বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে শুরু হয় প্রাথমিক আম বয়ান। ঈমান-আমলের এ বয়ান শুনতে ইজতেমা ময়দানের মুসলিস্নরা মশগুল। প্রায় এক বর্গ কিলোমিটারের বিশাল মাঠটিকে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে মুসলিস্নদের বয়ান শোনার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ ছাতা মাইক। লাগানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদু্যতিক বাতি। দেশীয় তাবলিগের মুসলিস্নদের জন্য জেলাওয়ারী আলাদা ৯১ ভাগে (খিত্তায়) ভাগ করা হয়েছে। শীত উপেক্ষা করে মঙ্গলবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলিস্নরা ইজতেমা ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় এসে অবস্থান নিচ্ছেন। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশি মুসলিস্ন যারা আসেন তাদের এয়ারপোর্টে ইজতেমা আয়োজকরা রিসিভ করে থাকেন। বিদেশি মুসলিস্নরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ইজতেমায় আসতে পারেন সেজন্য ইমিগ্রেশন থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে আসা ২১ সদস্যের একটি জামায়াত দলের সদস্য রোকনুজ্জামান জানান, ২১ সদস্য নিয়ে স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে ইজতেমা মাঠে এসেছেন, এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নিজ খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। এখানে এসে আমিরের নির্দেশনা অনুযায়ী যার যার কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ইজতেমায় অংশ নিতে জামায়াতবদ্ধ হয়ে এসেছেন সেলিম মিয়া। তিনি জানান, তীব্র শীত উপেক্ষা করে তারা ১৭ জনের সদস্য ইজতেমা মাঠে পৌঁছেছেন। গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট টিম কাজ করবে। ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং ছিনতাই-পকেটমারসহ নানা অপরাধ কার্যকলাপ রুখতে টহল টিম ও মোবাইল কোর্ট কাজ করবে, থাকবে পর্যাপ্ত ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ। প্রতিদিন কয়েকভাগে ভাগ হয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, 'প্রতিবার বিশ্ব ইজতেমায় তুরাগ তীরে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। তাই এবার আরও দু'টি নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে।' আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়াও মুসলিস্নদের চিকিৎসা সেবা দিতে শহীদ আহসান উলস্নাহ জেনারেল হাসপাতালে ১৮টি আধুনিক বেড উপহার দিয়েছেন তিনি। শহীদ আহসান উলস্নাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, 'স্বাস্থ্য বিভাগের সেবা কার্যক্রম প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মুসলিস্নদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে পাঁচটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসলিস্নদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে। এসব ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়াও টঙ্গী হাসপাতালে ডায়রিয়া, অ্যাজমা, ট্রমা, বক্ষব্যাধি, ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, নাক-কান-গলা, চক্ষু ও বার্ন ইউনিটের কার্যক্রম চলবে। এজন্য পর্যাপ্ত কেবিন ও বেড বাড়ানো হয়েছে। ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীর এ হাসপাতালে ৭টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন থাকবে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের তরফ থেকেও মেডিকেল ক্যাম্প বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে। চিকিৎসা বিভাগ ছাড়াও বিদু্যৎ, ফায়ার সার্ভিস সার্বক্ষণিক সেবাদান অব্যাহত রাখবে। ইজতেমা উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন ও বিআরটিসির স্পেশাল বাস চলাচল করবে।' জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর মিয়া জানান, ৩১টি টয়লেট বিল্ডিংয়ে একসঙ্গে ৯ হাজার মুসলিস্ন তাদের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। বিআরটিসি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে ইজতেমার মুসলিস্নদের আনা-নেওয়ায় বিশেষ বাস ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা নিয়েছে। ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর ওপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাঁচটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে মুসলিস্নদের পারাপারের জন্য। গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মোলস্ন্যা নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুই পর্বে পোশাকে, সাদা পোশাকে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন ১০ হাজার সদস্য। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগ ১৪টি কন্ট্রোলরুম তৈরি করেছে। র?্যাবের কন্ট্রোল রুম থাকবে, ডিএমপি তার এলাকায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে, ওয়াচ টাওয়ার, রুটটফ ডিউটিসহ সিআইডি, নৌ-পুলিশ, অবজারভারভেশন টিম থাকবে, র?্যাবের হেলিকপ্টার টহল থাকবে। ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্রোল টিম, বোম ডিস্পোজাল টিম থাকবে। ইজতেমার দুই পর্বেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলিস্নদের নিয়ে আসা গাড়ির নির্ধারিত পার্কিং ও মোনাজাতের আগের দিন শনিবার রাত থেকে মোনাজাতের দিন পর্যন্ত বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জানা যায়, ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে তাবলিগের দাওয়াতি কাজ শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর পর ১৯৪৮ সালে চট্টগামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে দ্বিতীয়বারের মতো তাবলিগের সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এর ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন তাবলিগের এ সম্মেলন শুধু ইজতেমা নামেই প্রচার ও পরিচিত ছিল। এরপর থেকে তাবলিগের প্রচার-প্রচারণা, সাথী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমা আয়োজন করা হয়। সে বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগের এ ইজতেমায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও তাবলিগের সাথীরা অংশগ্রহণ করেন। ওই বছর থেকেই এ ইজতেমাকে বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর বিশ্বব্যাপী 'বিশ্ব ইজতেমা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এ ইজতেমা। এরপর প্রতি বছরই 'কহর দরিয়া' খ্যাত তুরাগ নদীর উত্তর পূর্ব তীর সংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু জমি মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ ইজতেমা। যা বিশ্ব ইজতেমা নামে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সে হিসেবে ২০২৩ সালে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। উলেস্নখ্য, ২০১১ সালের আগে একসঙ্গে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো। স্থান সংকট এবং জনদুর্ভোগ বিবেচনা ও মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা উন্নতি ও নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তাবলিগের শুরা সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিন দিন করে দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজনের কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।