বিকল্প না রেখেই ভর্তুকি শূন্যের পথে জ্বালানি খাত!

মূলত দাতা সংস্থাগুলো সর্বজনীন ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কথা বলেছে। ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ অর্থাৎ যার প্রয়োজন তাকে দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারী দেশ তার অর্থনীতির জন্য বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ ও সময় পাবেন। হ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ম তামিম

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মঙ্গলবার বঙ্গভবনে এয়ার রেইড শেল্টার উদ্বোধন করেন -ফোকাস বাংলা
দু-সপ্তাহ না পেরোতেই চলছে ফের বিদু্যতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়। গ্যাসের নতুন দামে বিদু্যৎ উৎপাদনের বাড়তি ব্যয়ে ভর্তুকি না দিয়ে দাম সমন্বয়ের কথা জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। ফেব্রম্নয়ারিতেই গ্যাসের দাম কার্যকর হওয়ার পরপরই ঘোষণা আসতে পারে বিদু্যতের নতুন দামের। ফলে অনেকটাই ভর্তুকিশূন্য হওয়ার পথে যাচ্ছে দেশের জ্বালানি খাত। এদিকে কোনো ধরনের সমীক্ষা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা না রেখেই তেল-গ্যাসের পর দেশের বিদু্যতের ভর্তুকি বন্ধে উদ্বেগ জানিয়েছে জ্বালানি বিশ্লেষকরা। জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, 'এভাবে এত কম সময়ের ব্যবধানে বিদু্যতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার প্রভাব কি তা বোঝার আগেই এমন সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলে সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও দেশীয় উৎপাদনে যে সহায়তার প্রয়োজন পড়বে তা নিশ্চিত করা হয়নি। এর ফলে সীমাহীন ব্যয়ের চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাব অনুযায়ী চলতি মাসে বিদু্যতের দাম বাড়ানোর পরও গ্যাসের নতুন দামে বিদু্যৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সংস্থাটির কাছে বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে দাম না বাড়ালে আসন্ন গ্রীষ্মে বিদু্যৎ কিনতে পারবে না সংস্থটি। এদিকে সরকার পুরোপুরি ভর্তুকি তুলে নিলে দাম বাড়তে পারে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু কত বাড়বে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেল এবং এ বছরের জানুয়ারিতে ভর্তুকি তুলে নিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এ ছাড়া গত বছর নভেম্বরে পাইকারিতে প্রায় ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পর চলতি মাসেই গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদু্যতের দাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ম তামিম বলেন, 'যে হারে গ্যাসের দাম বেড়েছে তাতে বিদু্যতের উৎপাদান ব্যয় বাড়বে তা স্বাভাবিক। কিন্তু গ্যাসের দামে ভর্তুকি তুলে নেওয়াসহ গড় ক্রয়মূল্যের থেকে অনেক বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে এর চাপ পড়বে বিদু্যৎ খাতে। কারণ দেশের বিদু্যতের ৭০ ভাগই গ্যাসভিত্তিক।' তিনি বলেন, 'হঠাৎ করেই পুরো জ্বালানি খাত ভর্তুকিশূন্য করা হলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে পারে সে বিষয়ে সরকার কোনো ধারণা আমাদের দেয়নি। অথচ বর্তমান অর্থনীতি যে অবস্থায় এসেছে তার মূল কারণ জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রদান। হঠাৎ সব ধরনের জ্বালানিতে তা তুলে নেওয়া হলে সব ধরনের শিল্পসহ অভ্যন্তরীণ বাজারে সবকিছুর দাম একলাফে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে অস্বাভাবিক হারে। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবহণসহ ব্যয় বাড়বে কৃষিতে। কিন্তু তা মোকাবিলায় সরকার কি বিকল্প ব্যবস্থা নেবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। এদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। বিশেষ করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা অনেক দেশেই জ্বালানিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। যেসব দেশ ভর্তুকি দেয় না তারা বিকল্পভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ অর্থ অথবা আয়ের ওপর ভিত্তি করে সমপরিমাণ অর্থ ইউটিলিটি অথবা ট্যাক্স বিলে ছাড় দিয়ে থাকেন। আইএমএফের ঋণ সহায়তার শর্তের বিষয়টি উলেস্নখ করে জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দাতা সংস্থাগুলো সার্বজনীন ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কথা বলেছে। তবে ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ অর্থাৎ যার প্রয়োজন তাকে দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারী দেশ তার অর্থনীতির জন্য বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ ও সময় পাবেন। সাধারণত জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নিলে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের ব্যয় তার আয়ের ১০ শতাংশের বেশি যদি হয় তাহলে সরকারের উচিত তাকে সে বাড়তি অর্থ প্রদান করা। ডক্টর ম তামিম বলেন, সরকার ইতোমধ্যে গ্যাস ও জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে নিয়েছে, কিন্তু মানুষের আয় ও জ্বালানিতে ব্যয়ের পরিমাণ কত- সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। কৃষিতে কেবল সারই নয়, সরাসরি নগদ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাকে কিভাবে এই অর্থ দেওয়া হবে তা কেউ জানে না। দীর্ঘদিন ধরে একটা ডাটাবেজে তৈরির কথা থাকলেও তা এখনো করা যায়নি। অথচ এই ভর্তুকি তুলে নেওয়ার ফলে কৃষকসহ দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হবে জ্বালানির চাহিদা পূরণে। এর ফলে ব্যয় বাড়বে তার মৌলিক সব চাহিদায়। জ্বালানির ভাষায় যাকে বলা হয় 'প্রোভার্টি অব এনার্জি' বা 'জ্বালানির দারিদ্র্য'। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুলস্নার মতে, গোটা প্রক্রিয়াটাই অপরিকল্পিত এবং কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, 'বিদু্যতের দাম বাড়তেই পারে কিন্তু তা কতটুকু বাড়বে, জনগণের সক্ষমতা, ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তাসহ অর্থনীতিতে এর কি প্রভাব পড়বে তা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। এ ছাড়া বিইআরসিকে অকার্যকর করে নির্বাহী আদেশে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যা দেশের জ্বালানি নীতি ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে আগামীতে ডলার সংকট, আমদানি ব্যয়, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হওয়াসহ জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।