দেশের ৬৬ ভাগ নারী ঘরেই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গণমাধ্যমে বাড়ির বাইরের সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতাকে বেশি তুলে ধরা হলেও প্রকৃতপক্ষে নারীরা ঘরেই বেশি অনিরাপদ। বেসরকারি দাতা সংস্থা অ্যাকশন এইডের একটি গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি অ্যাকশন এইডের সহায়তায় পরিচালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির কনসালট্যান্ট আহমেদ ইব্রাহিম।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হল রুমে এই গবেষণা প্রবন্ধ উন্মোচন করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়, প্রচলিত ধারণা এবং পিতৃতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস হচ্ছে ‘নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ’। কিন্তু, প্রকৃত সত্য হচ্ছে নারীদের প্রতি বেশিরভাগ সহিংসতা বাড়িতে সংঘটিত হয়। ঘরের প্রতি তিন জনের মধ্যে দুইজন নারীই নানাভাবে পরিবারের লোকজনের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের ২০টি জেলায় সংঘটিত সহিংসতার তথ্য, পুলিশের কাছে রিপোটর্ হওয়া অভিযোগ, বিচার বিভাগীয় কাযর্ক্রম, জেএনএনপিএফ’র নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাবিরোধী সরকারি সংস্থা এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মিডিয়া প্রতিবেদন থেকে নেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন।
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ এই প্রচলিত বিশ্বাস এমন একটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, জনপরিসরে নারী নিরাপত্তাকে তা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এখন পযর্ন্ত কোনো আইনই এটা মানতে রাজি নয় যে, বিয়ের পর নারীরা ধষের্ণর শিকার হতে পারে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পকির্ত মামলাগুলোর প্রতি পঁাচটির মধ্যে চারটি মামলাই আদালতে উত্থাপিত হতে দুই বছর পযর্ন্ত সময় লেগে যায়। তারপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের পক্ষে বিচার পায়, ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পযাের্য় যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়। আদালত মামলা খারিজ করে দেয়ার বা আসামিকে খালাস দেয়ার সম্ভাবনা ৩২ শতাংশ। শুধু মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ মামলা থাকে পারিবারিক বিরোধসংক্রান্ত। যদিও বেশির ভাগ অভিযোগ পারিবারিক সহিংসতা অভিযোগ পারিবারিক সহিংসতা সম্পকির্ত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭৫ শতাংশ প্রতিবেদনে ধষর্ণ বা সংঘবদ্ধ ধষর্ণ সম্পকির্ত।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য মতে, সহিংসতা প্রতিবেদন কম হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অভিযোগ দাখিল সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকে না, এলাকার ক্ষমতাসীনদের বাধা এবং হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব, ঘরে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো সচেতনতামূলক কাযর্ক্রম না থাকা, মামলার ধীর গতির কারণে ভুক্তভোগীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে চায় না, বেশির ভাগ সময়ই ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে রায় যায়, যা তাদের আরও সমস্যায় সমস্যায় ফেলে দেয়।
সুপ্রিম কোটের্র নিদের্শনা বাস্তবায়ন
অনুষ্ঠানে ‘কমর্ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুপ্রিম কোটের্র নিদের্শনা ২০০৯ বাস্তবায়ন’ বিষয়ক পৃথক একটি গবেষণাপত্রও উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন। এতে বলা হয়েছে, কমর্ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোটের্র হাইকোটর্ ডিভিশন একটি তাৎপযর্পূণর্ রায় বা নিদের্শনা ঘোষণা করে। তবে এ নিদের্শনা প্রণয়নের দীঘর্ ৯ বছর পরেও কমর্ এবং এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কাযর্কর কোনো ব্যবস্থা বা কৌশল হাতে নিতে দেখা যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৪ শতাংশ শিক্ষাথীর্ যৌন হয়রানি প্রতিরোধসংক্রান্ত কমিটির কথা জানেন না। ৮৭ শতাংশ শিক্ষাথীর্ সুপ্রিম কোটের্র নিদের্শনা সম্পকের্ জানেন না।
কমের্ক্ষত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের নিদের্শনা বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষেত্রে কতৃর্পক্ষ বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ কমর্কতাের্দর অসচেতনতার উল্লেখযোগ্য অভাবের কথা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুপ্রিম কোটের্র নিদের্শনা সম্পকের্ কিছুই জানেন না। অন্যদিকে ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা নিদের্শনা সম্পকের্ জানলেও এ বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা তাদের নেই।
এই নিদের্শনা বাস্তবায়নে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং নিজ ঘরে এর ব্যাপকতা নিমূর্ল করার জন্য একটি আইন করা এবং তার বাস্তবায়ন করা, নারীরা যেন ঘরে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনাগুলো চিহ্নিত করতে পারে। সে জন্য তাদের সচেতন করতে হবে ও ক্ষমতা বাড়াতে হবে, নারীরা যাতে সহিংস ঘটনার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিংবা অভিযোগ করতে পারেন সে জন্য সব তথ্য দেবেন এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করবে সরকার। সুপারিশে গণমাধ্যমকে পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে নজর দেয়ার জন্য এবং সরকারকে দেশের আইনে বৈবাহিক ধষর্ণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহŸান জানানো হয়।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর ফারিয়া চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল করিম, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর সামিয়া হক, ভিকটিম সাপোটর্ সেন্টারের উপ-কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন প্রমুখ।
