৬ আসনের উপ-নির্বাচন

ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি কম অনিয়মের অভিযোগ অনেক

সংঘর্ষ-গুলি-ককটেল ও গোপন কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপস্থিতির অভিযোগ নিখোঁজ আসিফের স্ত্রী মেহেরীন বললেন 'অসুস্থ' নির্বাচন

প্রকাশ | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভোটারবিহীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের আড়াইসিধা কে বি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র
ম যাযাদি ডেস্ক বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের পর শূন্য হওয়া ছয় উপ-নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে শুরু হওয়া এই ভোটগ্রহণ চলে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। সবকটি আসনেই ইভিএমে ভোট হয়েছে। তবে ভোট চলাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ,র্ যাবের লাঠিপেটা-গুলি এবং একটি কেন্দ্র থেকে ককটেল উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, বগুড়া-৪ ও ৬ আসনের কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকার এজেন্ট বাদে অন্যদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ আসনে ভোটকক্ষের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখা গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন, ভোটে অনিয়ম বা কারচুপির উলেস্নখযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভোটগ্রহণ হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু। এদিকে, উপ-নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলোয় ভোটার উপস্থিতি কম দেখা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংঘর্ষ, লাঠিপেটা-গুলি আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের ভোট চলাকালে আওয়ামী লীগ ও 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এদিন বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত সদর উপজেলার শান্তির মোড় ও সোনার মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। লাঠিপেটা ও অন্তত ২০টি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেনর্ যাব ও বিজিবির সদস্যরা। এ আসনে নির্বাচন করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল ওদুদ, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি স্বতন্ত্রপ্রার্থী সামিউল হক (আপেল) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) মনোনীত প্রার্থী কামরুজ্জামান খান (টেলিভিশন)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা দুইটার দিকে শান্তির মোড় এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ ও 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর সমর্থকরা। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর দুটি নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করেন। এ সময় 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর সমর্থকরা নৌকার সমর্থকদের দুটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করেন। পুলিশ মোটর সাইকেল দুটি সদর থানায় নিয়ে যায়। শান্তির মোড় থেকে সরে গিয়ে নৌকার সমর্থকরা সোনার মোড়ে ককটেল ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। পুলিশ, বিজিবি,র্ যাবের সদস্যরা তাদের ধাওয়া দিয়ে লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ের্ যাব সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। 'বিদ্রোহী' প্রার্থী সামিউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি বাড়ির সামনে নির্বাচনী কেন্দ্রে বসে ছিলেন। তখন নৌকার সমর্থকরা অতর্কিত সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। তার পায়ে একটি ইট লেগেছে। পরে তার ছেলে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দুটি মোটর সাইকেল ভাঙচুরের বিষয়ে তিনি বলেন, পরের ঘটনা তিনি জানেন না। তার দাবি, অন্তত ১০টি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে নৌকার প্রার্থী আবদুল ওদুদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাইজার রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের কয়েকজন নেতাকর্মী মোটর সাইকেলে মাঝপাড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় আপেল প্রতীকের সমর্থকরা। এতে নবাবগঞ্জ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চ্যাটার্জি আহত হন। র্ যাবের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার রুহফি তাহমিন বলেন,র্ যাবের একটি টহল গাড়ি শান্তি মোড় থেকে বিশ্বরোড মোড়ের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। তাদের আঘাত থেকে বাঁচতে র?্যাব প্রথমে লাঠিপেটা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে র?্যাবের গাড়ির দিকে বোমা নিক্ষেপ করে তারা। তাদের হামলা থেকে বাঁচতে প্রায় ২০টি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আলমগীর জাহান বলেন, ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বগুড়ায় এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ আমাদের স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া জানান, বগুড়া-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকার এজেন্ট বাদে অন্যদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। বুধবার সকালে স্বতন্ত্রপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমসহ তিন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম উপজেলা) ও বগুড়া-৬ (সদর উপজেলা) দুই আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়েন হিরো আলম। বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বগুড়া সদরের এরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন তিনি। এরপরই সাংবাদিকদের কাছে একটি কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। প্রার্থী হিরো আলম সাংবাদিকদের বলেন, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে বগুড়া সদরের লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ওই কেন্দ্রে ঝামেলা হয়েছে। ভোটারদের মধ্যে ভীতি দেখা গেছে। বগুড়া-৬ আসনের আপেল প্রতীকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ও জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মাসুদার রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, 'পৌর শহরের মিশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে নৌকার এজেন্ট ছাড়া অন্যদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এ কেন্দ্রে আপেল প্রতীকের এজেন্টদেরও বের করে দেওয়া হয়েছে।' একই আসনের ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল মান্নান অভিযোগ করেন, 'নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ কেন্দ্রে ডাকাত পড়েছে। রাজাপুর ইউনিয়ন, নুনগোলা ইউনিয়ন, শাখারিয়া ইউনিয়ন, মানিকচক উচ্চবিদ্যালয়, ভান্ডার পাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতশিমুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়, শহরের সিটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বহু কেন্দ্রে আমাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে।' তবে অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, 'আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী কেউ কোনো ভোটকক্ষ থেকে কাউকে বের করে দেননি।' এদিকে, ভোটকেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। বগুড়া সদর এলাকার কেন্দ্রগুলো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানে ছিলেন। সকালের দিকে ভোটারদের উপস্থিতি ৪ ভাগের নিচে থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। দুপুরে তা কেন্দ্র ভেদে ১২ থেকে ২০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। বিকাল পর্যন্ত ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী হওয়ার গতি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। নারুলী উত্তরণ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা মাকসুদা রহমান স্মৃতি জানান, এ নিয়ে বর্তমান সংসদ নির্বাচনে বগুড়া- সদর নির্বাচনী এলাকায় ৩ বার ভোট দিয়েছেন। তিনি বিএনপি সমর্থক। ভোটার হিসেবে তার দায়িত্ব ভোট দেওয়া। সে কারণেই ভোট দিতে এসেছেন। তবে অন্যবারের তুলনার এবার উপ-নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি উলেস্নখ করে বলেন, বিএনপি না থাকায় ভোটকেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতির হার কম বলে তার ধারণা। বগুড়া করোনেশন স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রের পুরুষ কেন্দ্রে দুপুর দেড়টায় ভোটদানের হার ছিল প্রায় ২০ শতাংশ। প্রিসাইডিং অফিসার মো. মিজানুর রহমান জানান, দেড়টা পর্যন্ত তার কেন্দ্রে ভোটদানের সংখ্যা ছিল ৬৯১ জন। এখানে ভোট দিতে আসা লুৎফর রহমান জানান, নাগরিক অধিকার রক্ষায় তিনি ভোট দিতে এসেছেন। ভোট কেন্দ্রের পরিবেশে তিনি খুশি। বগুড়া ইসলামিক মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মহিলা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার প্রভাষক মো. শাহিন রেজা জানালেন, তার কেন্দ্রে ভোটার ২ হাজার ৬২০। দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ। করোনেশন স্কুলের মহিলা কেেেন্দ্র দুপুর দেড়টা ভোটদানের শতকরা হার ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। বগুড়ার সদর আসনের প্রায় সব কেন্দ্রেই ভোটারদের এমন চিত্র ছিল দুপুর পর্যন্ত। একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে বগুড়া-৪ আসনে। সেখানেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ভোটের সার্বিক পরিবেশ ভালো। দুপুর পর্যন্ত তার কাছে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। কিছু অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সমাধান করা হয়েছে। স্ট্রাইকিং ও মোবাইল কোর্ট সার্বক্ষণিক কাজ করেছে। তিনি জানান, দু'টি আসনে ৩৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ১৪ পস্নাটুন বিজিবি ছাড়াও পুলিশের ৪৬টি মোবাইল টিম, ও ৫টি স্ট্রাইকিং ফোর্স,র্ যাবের ১৭ টিম, ডিবির ৩টি স্পেশাল টিম কাজ করেছেন। তবে তিনি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত কম বলে স্বীকার করে জানান, পরিবেশ শান্ত ও ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিচ্ছে। গোপন কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ব্রাক্ষণবাড়িয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপ-নির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার নিজের এলাকা ও ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের তিনটি ভোটকেন্দ্রের ১৪টি ভোটকক্ষের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতির অভিযোগ উঠেছে। এসব কক্ষের কোনোটিতেই সাত্তারের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট দেখা যায়নি। তবে এই আসনের ৮২৬টি ভোটকক্ষের কোনোটিতেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ছিল না বলে জানা গেছে। অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পুরুষ ২ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, একজন ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের জন্য আঙুলের ছাপ মেলাচ্ছিলেন কলার ছড়ার এজেন্ট বাচ্চু মিয়া। তারপর ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষেও যান এই এজেন্ট। এ বিষয়ে বাচ্চু মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, 'উনিই আমাকে ওনার সঙ্গে ঢুকতে বলেছেন আমি ওনাকে দেখিয়ে দিতে গেছিলাম।' কক্ষের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, 'আমি একটু ওয়াশরুমে গেছিলাম। ভোট নিচ্ছিলেন পোলিং এজেন্ট।' পোলিং এজেন্ট খোকন চৌধুরী বলেন, 'আমি অন্য আরেকজন ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলাচ্ছিলাম?ওই এজেন্ট কখন ঢুকেছেন, খেয়াল করতে পারিনি।' এই কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষেই একই চিত্র দেখা যায়। মহিলা ভোটকক্ষে কলার ছড়ার এজেন্ট জয় রায়।?তাকেও একাধিকবার ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকতে দেখা যায়। অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মওদুদ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'কেউ অসুস্থ থাকলে তার সঙ্গে আসা কেউ ঢুকতে পারেন।' তার সামনেই এজেন্ট বাচ্চু মিয়াকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, তিনি গোপন কক্ষে গিয়েছিলেন কি না। বাচ্চু মিয়া ওই সাংবাদিককে বলেন, 'আমাকে ওই ভোটার ডাকছিল।' এরপর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আর কিছু বলেননি। সকাল সাড়ে ৮টার সময় নির্বাচনী এলাকার ১৩২টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্যে সরাইল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ৮৪টি ভোটকেন্দ্র ও আশুগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ৪৮টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। বিকাল সাড়ে ৪টায় শেষ হয় ভোটগ্রহণ। সরেজমিন সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি একবারে কম। ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল না। উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৫ জন প্রার্থী। এরা হলেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হওয়া এই আসনের ৫ বারের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী উকিল আবদুস সাত্তার ভূইয়া-(কলারছড়ি প্রতীক), জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবদুল হামিদ ভাসানী (লাঙ্গল), স্বতন্ত্রপ্রার্থী ও এই আসনের ২ বারের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা (আপেল প্রতীক), জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম জুয়েল-(গোলাপ ফুল), ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী ও আশুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা আবু আসিফ আহমেদ-(মোটরগাড়ি প্রতীক)। তবে প্রতীক বরাদ্দের পর স্বতন্ত্রপ্রার্থী অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন। এবং গত শুক্রবার রাত থেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ও আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বর্তমানে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি প্রতীক) নিখোঁজ রয়েছেন। তবে পুলিশের দাবি আবু আসিফ নিজেই আত্মগোপন করেছেন। আশুগঞ্জ উপজেলার তারুয়া ইউনিয়নের শালুকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ১ জন পুরুষ ও ৩ নারী ভোট দিতে এসেছেন। ভোট দিতে আসা শালুকপাড়ার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ নেই। হাবিবুর রহমান সকাল পৌনে ৯টার সময় তার ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসেন। এই ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ইভিএমের ভোট শুরু করতে ১০-১২ মিনিট লেইট হয়। ইভিএম ও কম্পিউটার চালু করতে একটু সময় লাগে। সকাল সাড়ে ৯টায় আশুগঞ্জ উপজেলার রওশন আরা জলিল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ২৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩১৮৩ জন। বেলা সাড়ে ১১টার সময় সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ১৯৮ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৪৪০৫ জন। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার সুমন মিয়া বলেন, কেন্দ্রে ৪ হাজার ৪০৫ ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে ৩ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ১৯৮টি। কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে উপ-নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি একটু কম। দুপুর ১টায় সরাইল উপজেলার বিশুতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় সাড়ে চার ঘণ্টায় এই কেন্দ্রে মাত্র ২২২ ভোট কাস্ট হয়। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩১২৯। দুপুর পৌনে দুইটায় সরাইল উপজেলার চুন্টা মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ৪৬৫ ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ২২১৬ জন। দুপুর ২টার সময় সরাইল উপজেলার চুন্টা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ৩৫০ ভোট কাস্ট হয়েছে। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩৫৭৪ জন। দুপুর আড়াইটার সময় সরাইল উপজেলার বাড়িউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ৪০১ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩০০৫ জন। বেলা ১১টায় উপ-নির্বাচনে আলোচিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী, বিএনপির পদত্যাগী নেতা ও এই আসনের ৫ বারের সাবেক সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভূইয়া তার নিজ ইউনিয়ন পাকশিমুল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে তাঁর ভোটাধিকার প্রদান করেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন জানান, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নিখোঁজ আসিফের স্ত্রী মেহেরীন বললেন 'অসুস্থ' নির্বাচন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-(সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপ-নির্বাচনকে 'অসুস্থ' মন্তব্য করে এই নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়েছেন নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী, বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা, আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আশুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও গত শুক্রবার থেকে নিখোঁজ আবু আসিফ আহমেদের স্ত্রী মেহেরুননিছা মেহেরিন। মেহেরুননিছা মেহেরিন বুধবার দুপুর ১টার দিকে আশুগঞ্জ উপজেলার শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের ভোট কেন্দ্রে নিজের ভোট দিতে যান। পরে ভোট কেন্দ্রের অব্যবস্থাপনা দেখে ভোট না দিয়ে কেন্দ্র থেকে চলে আসেন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরলে তিনি বলেন, 'এটি একটি অসুস্থ নির্বাচন। কিছুক্ষণ আগে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ নিয়ে অন্যজন ভোট দিচ্ছেন। দিনভর সব কেন্দ্রে এমনই হয়েছে। আমার কর্মীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। আগেও এজেন্টদের ভয় দেখানো হয়েছে। তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। যেহেতু নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, সেহেতু রেজাল্টটা কি আসবে? আপনারা বুঝতে পারছেন। আমাদের কর্মীরা পলাতক। এ অবস্থায় আমি আর কী বলতে পারি? নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবু আসিফ আহমেদ গত শুক্রবার থেকে নিখোঁজ। মঙ্গলবার তার সন্ধান চেয়ে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলমের কাছে লিখিত আবেদন করেছি। তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটের এই পরিবেশ দেখে ভোট না দিয়ে কেন্দ্র থেকে চলে এসেছি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সব কেন্দ্রেই একজনের ভোট আরেকজন দিচ্ছেন। ভোটের এই পরিবেশ দেখে আমি ভোট দিইনি। তিনি এই নির্বাচনকে 'অসুস্থ' উলেস্নখ করে নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানান। আশুগঞ্জ শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সৈয়দ রিয়াদ উদ্দিন বলেন, 'আবদুস সাত্তার ভূইয়ার (কলার ছড়ি প্রতীকের) এজেন্টরা গোপন কক্ষে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপ-নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার অরবিন্দ বিশ্বাস এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।' ঠাকুরগাঁওয়ে উপস্থিতি কম আমাদের পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও) আসনের উপ-নির্বাচনে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। মেঘলা আকাশ এবং ঠান্ডা বাতাসের কারণে সকালে ভোটার উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে। এ আসনে ১২৮টি কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪৩৯ জন। প্রতিটি কেন্দ্রে চারজন অস্ত্রধারী পুলিশ দুইজন মহিলা পুলিশ আনসার সদস্য মোতায়েন ছিলেন। এ ছাড়া সাত পস্নাটুন বিজিবি, ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্বক্ষণিক নজরদারি করেছেন। নির্বাচনে ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারা হলেন- ১৪ দলীয় জোট থেকে ওয়ার্কার্স পার্টির অধ্যাপক ইয়াসিন আলী (হাতুরী) ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফ্রন্টের (বিএনএফ) সিরাজুল ইসলাম টেলিভিশন) এবং জতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দীন আহম্মেদ (লাঙ্গল, জাকের পাটির এমদাদ হোসেন (গোলাপ ফুল), ন্যাশনাল পিলপলস্‌ পার্টির (এনপিপি) সাফি আল আসাদ (আম) ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র রায় (একতারা)। রিটার্নিং কর্মকর্তা জি এম সাহাতাব উদ্দীন বলেন, ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন এজন্য সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়। নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক রাখতে তিনস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।