লিকেজ থেকেই বেশি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ!

প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং তা থেকে অগ্নিকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনা। এ জন্য নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহারকে দায়ী করা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, বাজারে রান্নার জন্য যেসব গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়, সেগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। কারণ এলপিজি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তার চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি চাপ ধারণ করার ক্ষমতা এসব সিলিন্ডারের থাকে। তাই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি খুবই কম। মূলত সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে যথাযথভাবে পরিবহণ, মজুত ও ব্যবহার না করার কারণে। এছাড়া হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভে দুর্বলতার কারণে লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে জমতে থাকে। সামান্য আগুন এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে থাকা এই গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটছে। তাই গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ কেনার সময় সার্টিফাইড কোম্পানি কিংবা অনুমোদিত বিক্রেতাদের থেকে কেনার মত দেন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সবার আগে দেখতে হবে সিলিন্ডারের গায়ে মেয়াদ দেওয়া আছে কি না। সাধারণত একটি সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। যেটা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সেইসঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, পাইপ রাবারের রিং, রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না-সেটা পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি। কেননা দেশে ব্যবহৃত সিলিন্ডারগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও এর অনেক নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে যদি এর পাইপ, রেগুলেটর নিম্নমানের হয়। দেশের বাজারে ভালো খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। কিন্তু অনেকে না বুঝেই কমদামের মানহীন পণ্য কিনেন। আবার অনেকে অর্থ বাঁচাতে নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করেন। আর এসব কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা তদন্ত করতে \হগিয়ে তারা রেগুলেটর ও পাইপের লিকেজের কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের প্রমাণ পান। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে নিম্নমানের সিলিন্ডারের কারণে। এছাড়া সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণেও বেশকিছু দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটনার তদন্তকারী ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন জানান, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বেশির ভাগ ঘটনার নেপথ্যে থাকে ত্রম্নটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ব্যবহার। তার মধ্যে গ্যাস ভালভ ও রেগুলেটরে সবচেয়ে বেশি ত্রম্নটি পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে মানহীন হোস পাইপ থেকেও লিকেজ হয়। ওই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদেরও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। বিস্ফোরণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গুটি কয়েক বিষয়ে ভোক্তারা সচেতন হলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং এ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। এ বিষয়ে তাদের পরামর্শ হচ্ছে- গ্যাস ভরা সিলিন্ডার টানা হেঁচড়া করে, ধাক্কা দিয়ে, মাটিতে গড়ানো যাবে না। এলপিজি সিলিন্ডার খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। উপুড় বা কাত করে রাখা যাবে না। এমনভাবে রাখতে হবে যেন আশেপাশে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। সিলিন্ডার কোনো পাটাতনের ওপরে নয় বরং মাটিতে সমতল পৃষ্ঠে রাখতে হবে এবং চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে। সিলিন্ডার কোনোভাবেই চুলার/আগুনের খুব কাছাকাছি রাখা যাবে না। সিলিন্ডারটি লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে। সিলিন্ডার রান্নাঘরের চুলার নিচে, ক্যাবিনেটের ভেতরে কিংবা বদ্ধ অবস্থায় নয় বরং খোলামেলা জায়গায় এবং সমান ভূমিতে রাখতে হবে। যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে। তবে সরাসরি সূর্যের নিচে রাখা যাবে না। ছায়াযুক্ত শুষ্ক স্থানে রাখতে হবে। সিলিন্ডার যেখানে থাকবে সেখানকার একটি জানালা সব সময় খোলা রাখার চেষ্টা করতে হবে। না হলে ঘরের ওপরে ও নিচে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন চুলা চালু না থাকে। আগুন, বিদু্যৎ এবং তাপের যেকোনো রকম উৎস সেইসঙ্গে দাহ্য, প্রজ্বলিত বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোনো গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে। যেখানে সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে তার আশেপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না। রান্না শুরু করার আধাঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে। রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত গ্যাস বের করার জন্য এলপিজি সিলিন্ডারে চাপ দেয়া, ঝাঁকানো কিংবা সিলিন্ডার গরম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে তরল এলপিজি দ্রম্নত গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে অস্বাভাবিক চাপ বেড়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। সিলিন্ডারের ভালভ, গ্যাসের পাইপ বা ফিটিংস দুর্বল হলে কিংবা সিলিন্ডারে ছিদ্র থাকলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতে হবে। তা মেরামত, ঝালাই করে ব্যবহার করা যাবে না। এদিকে, শুধু সিলিন্ডারই নয়, লাইনের গ্যাসের লিকেজ থেকেও বড় বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত তিন বছরে গ্যাস, এলপিজি গ্যাস ও সিলিন্ডার থেকে অন্তত ২ হাজার ১৫২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসলাইনের ক্ষেত্রে লিকেজ (ছিদ্র) ও সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ব্যবহারে অসচেতনতাই বড় বিপদ ডেকে আনছে। তদারক সংস্থাগুলোর দায়িত্বে গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনায় এই বিপদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে মনিটরিং জোরদার করলে এই দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডক্টর এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, দুর্ঘটনাগুলোর আগে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস জমা হয়। মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমে বাতাসে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোনো স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ), ম্যাচের কাঠি বা আগুনের উৎস থাকলেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে যুক্ত হয় হাইড্রোজেন সালফাইড। যা নিজে দাহ্য না হলেও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য হয়। মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড এক হয়ে বেড়ে যায় দাহ্যতা। সে কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনও ধসে যেতে পারে। সিলিন্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত সিলিন্ডারগুলো পুরনো। এগুলো মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে বাইরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস ভর্তি করলে অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গ্যাস ধারণের ক্ষমতা হারিয়েও সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। অনেকে আবার বাসাবাড়িতে চুলার কাছে সিলিন্ডার স্থাপন করেন। এতে সরাসরি সিলিন্ডারে তাপ প্রবাহিত হয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। কেউ কেউ অসাবধানতাবশত সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করতে ভুলে যায়। এভাবে গ্যাস বেরিয়েও ঘটে দুর্ঘটনা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, সিলিন্ডার গ্যাসের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে প্রধানত মানহীন রেগুলেটর থেকে গ্যাস বের হয়ে। দীর্ঘক্ষণ গ্যাসের মধ্যে থেকে অভ্যস্ত হয়ে যায় বলে লিকেজের বিষয়েও বুঝতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।