শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এজেন্টদের সুবিধা দিতেই গলা কাটছে গ্রাহকের

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে একাধিপত্য ব্যবসা-২
এম সাইফুল
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

গ্রাহকদের জিম্মি করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি লেনদেনে দুই এজেন্টকে কমিশন দিচ্ছে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এজেন্টদের সুবিধা দিতে গিয়েই গ্রাহকের গলা কাটছে তারা। এমনকি ক্যাশ ইন করার পর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে আরেকটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সেন্ড মানি করতেও টাকা কাটা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকদের নগদ উত্তোলন এবং আমানত লেনদেনের জন্য একটি ব্যাংক শাখায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। কিন্তু লেনদেন পরিচালনার ব্যয় বৃদ্ধি করে গ্রাহককে জিম্মি করা এক ধরনের অনৈতিক ব্যবসা।

খরচ বাড়ার কারণ : এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একই গ্রাহকের লেনদেনের ক্ষেত্রে দুই এজেন্টকে কমিশন দেওয়া হচ্ছে। অথচ গ্রাহককে বলা হচ্ছে, ক্যাশ ইন ফ্রি। কিন্তু যিনি ক্যাশ আউট করছেন তার খরচ থেকে যেই এজেন্ট ক্যাশ ইন করেছে তাকেও কমিশন দেওয়া হচ্ছে। যদি ক্যাশ ইন ফ্রি হয়, তাহলে ক্যাশ আউট খরচ ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

জানা গেছে, এজেন্টদের নিয়মিত প্রতিটি ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউটে প্রতি হাজারে ৪ টাকা ১০ পয়সা করে ৮ টাকা ২০ পয়সা কমিশন দেওয়া হয়। এরপর আবার বড় অঙ্কের টাকা ক্যাশ ইন হলে বোনাস হিসেবে কমিশনও দেওয়া হয়। পাঁচ হাজার থেকে ওপরের বিভিন্ন পরিমাণ টাকা ক্যাশ ইন হলে এজেন্ট এক টাকা করে বোনাস পায়। ১০ হাজার টাকা হলে ২ টাকা বোনাস পায়। অর্থাৎ প্রতি ৫ হাজারে ১ টাকা করে বোনাস পায় এজেন্ট।

এজেন্টদের সূত্রে আরও জানা গেছে, আবার যদি অ্যাপসের মাধ্যমে ক্যাশ ইন করে সেবাদানকারী কোম্পানি তাহলে এজেন্টদের ৪ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত কমিশন দেয়।

এছাড়া ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট মিলিয়ে ১০ লাখ টাকা লেনদেন করতে পারলে অতিরিক্ত ২০০ টাকা পর্যন্ত কমিশন দেওয়া হয়।

খরচ কমানোর উপায়

জানা গেছে, এজেন্ট কমিশন কম দিয়ে লেনদেন করতে পারলে খরচ অনেকাংশে অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। যেমন রকেটের টাকা ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ক্যাশ আউট করলে ৯ টাকা খরচ। অথচ এজেন্ট থেকে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের রকেটে ক্যাশ আউট চার্জ প্রতি হাজারে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা। বিকাশের টাকা ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করলে খরচ ১৪ টাকা ৯০ পয়সা। আর এজেন্ট থেকে উত্তোলন করলে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। বিকাশের রেটই বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ ক্যাশ আউট চার্জ।

অথবা যেই এজেন্ট ক্যাশ ইন করবেন তিনি বিনা কমিশনে করবেন। শুধু তিনি ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে কমিশন পাবেন। তাহলেও খরচ কমে আসবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি ক্যাশ ইন বিনামূল্যে করা না যায়, তাহলে নামমাত্র কমিশনিং করা যেতে পারে। সেটি অবশ্যই এক টাকার নিচে হতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ধারণা গ্রাহকরা বাধ্য হয়েই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করবেন। এজন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী কোম্পানিগুলো গ্রাহকের খরচ কমানোর দিকে কোনো নজর দিচ্ছে না। এজেন্টদের কত বেশি সুবিধা দেওয়া যায় সেটাই মূল লক্ষ্য। এমনকি এক কোম্পানি আরেক কোম্পানি থেকে এজেন্টকে কী বেশি সুবিধা দেওয়া যায়, সেই প্রতিযোগিতায় সবাই ব্যস্ত।

উচ্চ ফি'র কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সতর্ক করে নির্দেশনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হাজার কোটি টাকার লেনদেনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই সেবার মাধ্যমে কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে, এই হাসি যেন কোনোভাবেই লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে না যায়। ১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে সেবাপ্রদানকারীদের প্রতি নীতিনির্ধারক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনযাত্রা আরও সহজ করতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ কমানো সম্ভব। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এই সেবার খরচ আরও কমবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রাহককে জিম্মি করে এভাবে এজেন্ট-নির্ভর ব্যবসা করা অত্যন্ত অনৈতিক। এ ধরনের ব্যবসা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতামত

বিকাশে অংশীদার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ডক্টর আহসান এইচ. মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত এজেন্টদের খরচ কমাতে হবে। গ্রাহকের কথা ভাবতে হবে। এখন হয়তো গ্রাহককে বেশি টাকা দিয়ে লেনদেন করাতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তি যেভাবে উন্নত হচ্ছে তার বিকল্প তৈরি হবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্যাশ আউটের বিপক্ষে। ওয়ালেট থেকে টাকা খরচ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কোনো ফি দিতে হবে না।

এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর ডক্টর আতিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হওয়ার পর মানুষ যেভাবে অ্যাকাউন্ট খুলছে তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা অ্যাকাউন্টে জমাচ্ছে। আবার এক নিমিষেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা পাঠাচ্ছে। এই সুযোগটি যত সাশ্রয় হবে মানুষ ততই বেশি ব্যবহার করবে। কিন্তু খরচ বাড়িয়ে কোনোদিন গ্রাহক ধরে রাখা যাবে না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় কথা বলেছি। খরচ কমানোর জন্য দাবিও জানিয়েছি।

প্রসঙ্গত, একজন গ্রাহককে নগদ উত্তোলন বা আমানতের জন্য একটি এটিএম বা ব্যাংক শাখায় যেতে হয়। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যেকোনো জায়গা থেকে টাকা লেনদেন করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্‌?-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে