শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিমান্ড ফেরত আসামির জেলে মৃতু্যর দায় নিচ্ছে না কেউ

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

পুলিশের রিমান্ড শেষে কারাগারে ফিরে স্বল্প সময়ের মধ্যে যেসব আসামির অস্বাভাবিক মৃতু্য হচ্ছে, তার দায় নিচ্ছে না কেউই। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে জেলখানায় আসার পর কেউ কেউ মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ছে। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য, মেডিকেল চেকআপ করিয়েই আসামিকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে নির্যাতনের কারণে কারও মৃতু্য হলে সে দায় তাদের নয়। যদিও পাল্টাপাল্টি দোষারোপের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেউ সরাসরি কোনো বক্তব্য দেননি।

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, কারাগারে কোনো আসামির মৃতু্য হলে তা 'স্বাভাবিক মৃতু্য' কিংবা 'আত্মহত্যা' বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এসব ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত না হওয়ায় বিষয়টি গতানুগতিক একই ধারায় চলছে। তাদের মতে, গত চার বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৩২৮ বন্দির মৃতু্য হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই নির্যাতনের শিকার। এছাড়া কারাগারে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্যে পাওয়া না গেলেও একাধিক কারা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিমান্ড ফেরত আসামিদের মেডিকেল চেকআপ করে কারাগারে নেওয়া হয়। পুলিশ হেফাজত থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কাউকে পাঠানো হলে ওই আসামি গ্রহণ করা হয় না। তবে অনেক সময় পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সুপারিশে তারা এসব আসামি কারাগারে নেন। এ সময় একটি নোট রাখা হয়। তারপরও ওই আসামি মৃতু্যবরণ করলে তখন কারা কর্তৃপক্ষের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দি রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে এসব কারাগারে কমপক্ষে ৩২৮ জন বন্দির মৃতু্য হয়েছে। সম্প্রতি এক দিনেই গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বন্দির মৃতু্য হয়।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, 'বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় মানসিক চাপ, আন্তঃসামাজিক

মর্যাদাগত চাপ ও ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বন্দি, রাতের বেলা হার্ট অ্যাটকসহ অন্যান্য গুরুতর অসুখে তাৎক্ষণিক ও যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়া কারাগারে বন্দি মৃতু্যর কারণ। এছাড়া গ্রেপ্তারের পর থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের যে পদ্ধতি অর্থাৎ মারধর বা নির্যাতনের কারণে তাদের মৃতু্য হয়।'

বন্দি মৃতু্য নিয়ে কারাগারের তদন্তের বিষয়ে নূর খান লিটন বলেন, 'বন্দি মৃতু্য নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময় গৎবাঁধা কথা বলে। তারা "স্বাভাবিক মৃতু্য" অথবা "আত্মহত্যার" কথা বলে থাকে। আবার এসব মৃতু্যর ঘটনায় করা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপরও দেশের মানুষের কোনো আস্থা নেই।'

এই মানবাধিকার সংগঠক বলেন, 'কারাগারে একজন সাধারণ বন্দি অসুস্থ হলে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এছাড়া প্রকৃত অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে জায়গা পায় না। এখানে যার টাকা আছে, তারা সহজেই বেড পেয়ে যায়।'

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত কারাগারে ৩২৮ জন বন্দির মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির সংখ্যা ১২৩ এবং আটক আসামির সংখ্যা ২০৫। বছর হিসেবে ২০১৮ সালে ৭৪ জন, ২০১৯ সালে ৫৮ জন, ২০২০ সালে ৭৫ জন, ২০২১ সালে ৮১ জন ও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪০ জন বন্দির মৃতু্য হয়েছে।

জানা গেছে, কুমিলস্না কেন্দ্রীয় কারাগারে গত বছরের ১১ আগস্ট আনোয়ার হোসেন নামের ডাকাতি মামলার এক আসামির মৃতু্য হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, হার্ট অ্যাটাকে তার মৃতু্য হয়েছে। তবে পরিবারের অভিযোগ, গ্রেপ্তারের পর পুলিশি নির্যাতনে কারাগারে মারা গেছেন আনোয়ার। গত ৪ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর কারাগারে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি তোফায়েল আহমেদের মৃতু্য হয়। কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃতু্য হয় তার। তবে জেলা বিএনপির অভিযোগ, কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিতে গাফিলতির কারণে মৃতু্য হয়েছে তোফায়েলের।

এমন একটি বা দু'টি নয়, কারাগারে বন্দি মৃতু্যর অধিকাংশ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে সন্দেহ প্রকাশসহ উদ্বেগ জানিয়ে আসছে ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কারা কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ ঘটনায় 'স্বাভাবিক মৃতু্য' দাবি করলেও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে 'নির্যাতন' বা 'অবহেলাজনিত মৃতু্য' এবং কখনো কখনো 'হত্যাকান্ড' বলে অভিযোগ করা হয়। থানায় পুলিশের নির্যাতন, কারাগারে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, চিকিৎসায় চরম অবহেলা, মানসিক নির্যাতন ও অতিরিক্ত বন্দির চাপসহ বিভিন্ন কারণে বন্দি মৃতু্যর ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ তাদের।

সম্প্রতি জেল থেকে মুক্তি পাওয়া একাধিক কয়েদি ও আসামি জানান, 'কারাগারে হাসপাতাল থাকলেও সেখানে বেড পেতে হলে টাকা লাগে। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। আর সেই অনুমতি নিতে গিয়ে প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে মারা গেলে বলা হয় ''স্বাভাবিক মৃতু্য''। আবার হাসপাতালে বেশিরভাগ রোগের জন্য একই ধরনের গতানুগতিক ওষুধ দেওয়া হয়। তবে আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলে কারাগারের ভেতরে তেমন কষ্ট হয় না। থাকা-খাওয়াসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সাধারণ বন্দিদের আর্থিক সামর্থ্য বা রাজনৈতিক পরিচয় না থাকার কারণে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগের পাশাপাশি বঞ্চনার শিকার হতে হয়।'

সূত্রমতে, গত বছর ২৫ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ১০ মাস কারাবন্দি থাকা অবস্থায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান। তার মৃতু্যকেও 'স্বাভাবিক মৃতু্য' হিসেবে দাবি করে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে রাজধানীর শাহবাগে সড়ক অবরোধ আন্দোলন থেকে মুশতাক আহমেদের মৃতু্যকে 'সরকারি মদদে হত্যাকান্ড' আখ্যায়িত করে বিচারিক তদন্তের দাবি জানান বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গত ১৩ মার্চ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি জহিরুল মারা গেলে অসুস্থতার কথা বলে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে তার বড় ভাই আলী আকবর গণমাধ্যমকে বলেন, 'পিবিআইয়ের লোকজন জহিরুলকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে না দিয়ে ব্যাপক মারধর করলে কারাগারে মারা যায় সে। মারা যাওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে কারাগারের মধ্যে কিছু লোক জোর করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দেয় বলেও পরিবারকে জানিয়েছিল জহিরুল।' ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় আগুনে পুড়ে মারা গেলে কর্তৃপক্ষ 'আত্মহত্যা' বলে প্রকাশ করে। ওই সময় তার পরিবার আত্মহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে