নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন শেষে শেখ হাসিনা

'মৈত্রী পাইপলাইন' একটি মাইলফলক

'এই পাইপলাইনের মতো আগামী দিনে আরও সফলতা বাংলাদেশ-ভারত উদযাপন করবে। আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একই সঙ্গে কাজ করব।'

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে 'ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন' উদ্বোধন করেন -স্টার মেইল
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'মৈত্রী পাইপলাইন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের একটি মাইলফলক অর্জন। এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।' শনিবার বিকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে 'ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন' উদ্বোধন শেষে তিনি এসব কথা বলেন। পাইপলাইনটি উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তেল আসা শুরু হলো। আগে রেলপথে ভারত থেকে তেল আনা হতো বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, 'এই পাইপলাইনের মতো আগামী দিনে আরও সফলতা বাংলাদেশ-ভারত উদযাপন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা একই সঙ্গে কাজ করব।' এই পাইপলাইনের সুফলের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ চালুর ফলে দুই দেশের জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি। এই পাইপলাইনটি আমাদের জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।' এই পাইপলাইনে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় ও সময় উলেস্নখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'এরফলে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহও নিশ্চিত করবে।' শেখ হাসিনা বলেন, '২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আমি, আমরা ভার্চুয়ালি এই প্রকল্পের কাজ শুরু করি। ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অংশে পড়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার, ভারতের অংশে ৫ কিলোমিটার।' প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, ভাতৃপ্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সেতুবন্ধন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর করেছে।' দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবে রূপ দান করেছি। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সমস্যগুলো একে একে আমরা সমাধান করেছি। যোগাযোগ স্থাপন করেছি, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার আমরা ঘটিয়েছি।' শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা উন্নয়নে এক সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছি। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও উভয় \হদেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে জ্বালানি ও বিদু্যৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে সেটাকে আমরা কার্যকর করতে চাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিক রেখে দুই দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়নে আমরা কাজ করে যেতে চাই। আমরা চাই আমাদের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হোক।' ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। আমি চাই ভারতের বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগ করুক। আমরা দুই দেশই তাতে লাভবান হবো। ভারত থেকে বাংলাদেশের ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিদু্যৎ ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরও কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন।' মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা কৃতজ্ঞ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১ কোটি বাঙালি শরণার্থীকে স্থান দেওয়া, খাবারের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া এবং অস্ত্র দেওয়া- এসব সহযোগিতা ভারতের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বাহিনীর অভিযানে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।' ১৯৭৫ সালের পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে ঋণী। আমরা দুই বোন তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের আরও আত্মীয় স্বজন যারা বেঁচে গিয়েছিল তারাও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজেই আমি ভারতের কাছে, ভারতের জনগণের কাছে, সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।' যৌথ এ পাইপলাইন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারত প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বক্তব্য দেন। উদ্বোধনী দিনেই এলো জ্বালানি তেল এদিকে, ভারতের শিলিগুড়ি লুমানিগড় তেল শোধনাগার থেকে ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে পার্বতীপুরে এসে পৌঁছেছে জ্বালানি তেল। দেশে প্রথমবারের মতো পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারায় বছরে সাশ্রয় হবে শত কোটি টাকা। উদ্বোধনী দিনেই প্রায় ১ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন ডিজেল তেল রিসিভড করে পার্বতীপুরের রিসিভ টার্মিনাল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে পার্বতীপুর রিসিভড স্টেশনকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। প্রধান ফটকে শোভা পায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে সাজানো হয় পার্বতীপুরের প্রধান প্রধান সড়কের দু'ধার। উপজেলা পরিষদ হল রুমে আয়োজন করা হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকি। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান এমপি। উপস্থিত ছিলেন পিবিসির পরিচালক অপারেশন খালেদ আহম্মেদ, অপারেশন মার্কেটিং অনুপম বড়ুয়া, পদ্মা কোম্পানির এমডি মো. মাসুদুর রহমান, মেঘনা কোম্পানির এমডি মো. আবু সালেহ ইকবাল, যমুনা কোম্পানির এমডি গিয়াস উদ্দিন আনসারী, পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. হাফিজুল ইসলাম প্রামাণিক. পৌর মেয়র মো. আমজাদ হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ ইসমাঈল। পরে অতিথিরা জ্বালানি তেল রিসিভড স্টেশন ঘুরে দেখেন। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম তিন বছর বার্ষিক দুই লাখ টন করে, পরের তিন বছর তিন লাখ টন করে, পরের চার বছর পাঁচ লাখ টন করে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে বার্ষিক ১০ লাখ টন করে জ্বালানি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ এ পাইপলাইনে ৪৭ লাখ লিটার বা চার হাজার ৭০০ টন তেল সব সময় সংরক্ষিত থাকবে। শিলিগুড়ি প্রান্ত থেকে নতুন তেল দিয়ে চাপ দিলেই পার্বতীপুর প্রান্তে পাইপের তেল বেরিয়ে ছাকনি প্রক্রিয়া শেষে ডিপোতে জমা হবে। পার্বতীপুরে আগে থেকেই বিপিসির ১৫ হাজার টন তেল মজুত করার মতো ট্যাঙ্কার রয়েছে। নতুন করে সেখানে আরও ছয়টি ট্যাঙ্কার নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ধারণ ক্ষমতা ২৯ হাজার টন। এর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিজেল আমদানির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই হয়। একই বছরের অক্টোবরে এনআরএল বাংলাদেশে ডিজেল রপ্তানির জন্য বিপিসির সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি আরেকটি চুক্তি করে। আনুষ্ঠানিকতার পর্যায় পেরিয়ে এরপর ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাইপলাইনের কাজ উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি।