অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুমোদন করেন ইয়াহিয়া

প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

বীরেন মুখার্জী
অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিনেও বাঙালির দৃপ্ত পদচারণায় টালমাটাল ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ। একাত্তরের এই দিন সকালে রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ডক্টর কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। সোয়া দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু যখন প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বাইরে আসেন, তখন শত শত কণ্ঠের 'জয়বাংলা' সেস্নাগান বঙ্গবন্ধুকে আচ্ছন্ন করে। বঙ্গবন্ধু দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, 'আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। সময় এলে অবশ্যই আমি সবকিছু বলব।' এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সিদ্দীক সালিকের বই থেকে জানা যায়, এদিন ঢাকা সেনানিবাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠঠাসহ পদস্থ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি সামরিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন চিরতরে দমনের নীলনকশা হিসেবে 'অপারেশন সার্চলাইট' অনুমোদন করেন। লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী একাত্তর সালের এই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে তার '৭১ এর দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন, ২০ মার্চ রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে এক অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত।' এই দিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক নৌসেনাদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই দিন একের পর এক শোভাযাত্রা নিয়ে মুক্তি প্রত্যাশিত জনতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। সমবেত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনো শক্তিই রুখতে পারবে না।' করাচিতে পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে সন্তোষজনক জবাব পেয়ে ঢাকা যাচ্ছেন। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি এই দিন সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। একাত্তরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই ছয়টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত পিআইএ ফ্লাইটে করে সৈন্য ও রসদ ঢাকায় আনা হচ্ছিল। কয়েকটি জাহাজ পূর্ণ করে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হচ্ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে বাংলাদেশে পাকিস্তানের স্থলবাহিনীর শক্তি ছিল এক ডিভিশন, ২০ মার্চ তা হয় দুই ডিভিশনের বেশি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই বিমান চলাচল বন্ধের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। জয়দেবপুরে এই দিনও সান্ধ্য আইন অব্যাহত ছিল। এই দিন বঙ্গবন্ধু আরেকটি বিবৃতিতে বলেন, '২৩ মার্চ লাহোর দিবস উপলক্ষে ছুটি থাকবে সারা বাংলাদেশে। ১৪ মার্চ ঘোষিত নির্দেশ ও ব্যাখ্যা মতো সবকিছু চলবে। আগামীকে যেসব নির্দেশ দেওয়া হবে সে মতে সব কর্মসূচি পালন করতে হবে।' মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক ঘোষণায় বলেন, '২৩ মার্চ স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস হিসেবে পালিত হবে।' চট্টগ্রাম এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ দিতে ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। এই দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা ওড়ানো অব্যাহত থাকে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। দেশজুড়ে স্বাধীনতার দাবিতে সভা-শোভাযাত্রা চলে। এই দিন মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে বাঙালিদের সঙ্গে বিহারি ও সেনাবাহিনীর দাঙ্গা শুরু হয়। তথ্যসূত্র : '৭১ এর দশ মাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা।