বাজার নিয়ন্ত্রণে হার্ডলাইনে সরকার

দেশীয় কোম্পানিগুলো মিলগেটে সঠিক সময়ে সঠিক দামে পণ্য সরবরাহ করলে বাজারে কোনো পণ্যের সংকট হবে না, দামও বাড়বে না। তবে খুচরা বাজারের মনিটরিংয়ের অভাবে সরকারের অনেক উদ্যোগের সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক হতে হবে

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবার হার্ডলাইনে সরকার। কোনো পরিস্থিতিতেই বাজার যাতে অস্থির হতে না পারে সেজন্য একগুচ্ছ কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজার মনিটরিংসহ চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে নেওয়া হয়েছে জোরালো উদ্যোগ। প্রয়োজনে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে মজুত স্বাভাবিক রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মন্ত্রণালয়টির সূত্র বলছে, এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পূর্বগঠিত বাজার মনিটরিং কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একযোগে মাঠে নামছে। একই সঙ্গে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিএসটিআই জানিয়েছে, মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে ঢাকার বাজারে প্রতিদিন তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। বন্ধের দিনও চলবে এ কার্যক্রম। পাশাপাশি সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ কার্যক্রম চালানো হবে বলে সংস্থাটি ঘোষণা করেছে। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন জানান, রমজানে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের ওজন ও পরিমাপে কারচুপি রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে। এছাড়া ৫ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে বিএসটিআই। একই সঙ্গের্ যাব ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান রমজানে হার্ডলাইনে থাকার ঘোষণা দিয়ে জানান, রোজা এলেই দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়। প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বিশেষ করে কম আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। তাই এবার রোজায় কঠোর অবস্থানে থাকবে অধিদপ্তর। অন্যদিকে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী, আমদানিকারক এবং বাজার কমিটিগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সংগঠনের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'বাজার স্থিতিশীল রাখতে ইতোমধ্যে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এক্ষেত্রে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ভোক্তাদের কাছ থেকে পণ্যের অযৌক্তিক দাম আদায় করতে না পারে সে বিষয়ে বাজার কমিটিগুলোকে তৎপর থাকবে। কোনো বাজারে অযৌক্তিক মূল্যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হলে এবং এ বিষয়ে বাজার কমিটির উদাসীনতা দেখা গেলে সরকার কমিটির লাইসেন্স বাতিল করবে জানিয়ে সবাইকে সতর্ক করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।' স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসন্ন রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, বাজারে কৃত্রিম সংকটরোধ, পণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি মাঠে সক্রিয় থাকবের্ যাবও। বাড়ানো হবে গোয়েন্দা নজরদারি। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, রমজানে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিনগুণ জনবল নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। প্রথমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে মাঠে নামছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে জনশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপস্নব কুমার সরকার বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এবং পুলিশের সহায়তায় ঢাকা মহানগরের প্রত্যেকটি স্থানে প্রতিদিন বাজার মনিটরিং করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব অভিযান পরিচালনা করবে। সম্ভাব্য অভিযানে নতুন নতুন উদ্যোগ যুক্ত করা হবে উলেস্নখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, 'অবশ্যই এবার ভিন্নভাবে ও ভিন্ন কৌশলে অভিযান পরিচালিত হবে।' দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তদারকিতের্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব) এর পদক্ষেপ সম্পর্কে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, 'রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এবার আমাদের একাধিক টিম মাঠে কাজ করবে।র্ যাব মূলত ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে। মার্কেট-শপিংমলে আমাদের যে ক'জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন, তাদের নির্দেশনা মোতাবেক নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।' এদিকে আসন্ন পবিত্র রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে কোনো মহল যাতে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল কিংবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের জন্য মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছ। এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে বলে দাবি করেছেন উপ-পরিচালক মাসুম আরেফিন। তিনি বলেন, 'ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি জোরালো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, যেখানে যেখানে গ্যাপ রয়েছে সেগুলো পূরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাজারের মনিটরিং করতে এবার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেশজুড়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের তিনগুণ কর্মী মাঠে থাকবে। এবার বিশেষভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে।' রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে হার্ডলাইনে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও। মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, 'এ বছর রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের অহেতুক দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের অবগতির জন্য ডিএনসিসির সাতটি মার্কেটে মূল্য তালিকাসহ প্রতিটি ৬০ স্কয়ার ফুট সাইজের ডিজিটাল ডিসপেস্নবোর্ড স্থাপন করে দেওয়া হবে। এছাড়াও প্রতিটি দোকানে প্রকাশ্যে মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখতে হবে।' উত্তরের সব বাজারে নজরদারি আরও জোরদার করা হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, 'কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলামকে আহ্বায়ক করে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে একটি বাজার মনিটরিং কমিটি করা হবে। পুরো রমজান মাস জুড়ে এই কমিটি বাজারগুলো মনিটরিং করবে। রমজানে জনগণের যেন কোনো ভোগান্তি না হয় সেটি নিশ্চিত করা হবে।' এদিকে চট্টগ্রামসহ অন্য সমুদ্র বন্দর ও স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার করে রমজান উপলক্ষে আনা প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো যাতে দ্রম্নত খালাস হয় সে বিষয়ে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিত্যপণ্য আমদানির এলসিগুলো দ্রম্নত নিষ্পত্তির জন্যও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুরোধ জানিয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পণ্যের মজুত আছে। এবার কোনো ধরনের সংকট হবে না। রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ সভা করে বাজার ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে সরকার। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, দেশীয় কোম্পানিগুলো মিলগেটে সঠিক সময়ে সঠিক দামে পণ্য সরবরাহ করলে বাজারে কোনো পণ্যের সংকট হবে না, দামও বাড়বে না। তবে খুচরা বাজারের মনিটরিংয়ের অভাবে সরকারের অনেক উদ্যোগের সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক হতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে রমজানের সময় নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার সব আয়োজন করেছে। এসব আয়োজনের বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার। তিনি বলেন, রমজানে কোনো পণ্যের সংকট হবে না। সব ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মজুত সন্তোষজনক।