সিপিডির সংবাদ সম্মেলন

ঢাকায় এক বছরে পরিবারপ্রতি খাবার খরচ বেড়েছে ২৫%

'সীমিত আমদানিকারকরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে' মোট আয়ের ৬০ শতাংশ খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়

প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ঢাকা শহরের চারজনের এক পরিবারে প্রতি মাসে খাবারের পেছনেই খরচ হয় ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। তবে মাছ-মাংস না খেলে এই খরচ দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৩১ টাকায়। এই হিসাব গত ফেব্রম্নয়ারি মাসের। এক বছরের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি খাবার খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সোমবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাজেট প্রস্তাববিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এই চিত্র তুলে ধরা হয়। এদিকে, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, মরিচ, হলুদ, আদা, রসুনসহ ১৭টি নিত্যপণ্যের প্রতিদিনের বাজারদর এবং একজন মানুষ গড়ে কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে এর ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করেছে। সিপিডি বলছে, একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মোট আয়ের ৬০ শতাংশ খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য দেন গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ। সিপিডি আরও বলেছে, ২০২২ সালে ফেব্রম্নয়ারিতে ঢাকা শহরের চারজনের এক পরিবারে প্রতি মাসে খাবার কিনতে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। মাছ-মাংস না খেলে সেই খরচ ছিল ৫ হাজার ৬৮৮ টাকা। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি খাতে ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করা উচিত। পারলে এই ঈদেই বেতন-ভাতা বাড়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। তাই সব খাতের নূ্যনতম মজুরি বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া এমন অবস্থায় আগামী বাজেটে করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে নূ্যনতম করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। কয়েক মাস ধরেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চাল, ডাল, তেলের পাশাপাশি মাছ-মাংস, ডিমের দামও বেশ চড়া। সবশেষ বাজারদর অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। আর এলাকাভেদে ১ ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪৫ টাকায়। মাছ-মাংসের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের খাবারের পাত থেকে মাছ-মাংস উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সিপিডি আরও যেসব সুপারিশ করেছে তা হলো- পাচারের টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে ৭ শতাংশ কর দিলে কোনো প্রশ্ন করবে না সরকার, আগামী বাজেটে এই সুযোগ বন্ধ করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। সিপিডি বলছে, এই ধরনের সুযোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগও বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে সিপিডি। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য একটি ব্যাংক কমিশন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। ভর্তুকি কমাতে বিদু্যৎ-জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সমালোচনা করেছে সংস্থাটি। সিপিডি বলেছে, বিদু্যতের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রতি মাসে একবার পর্যালোচনা করা উচিত। বিদু্যৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রথা বাতিল করে 'নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে' ব্যবস্থায় যাওয়া দরকার। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবণতা, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাংকে তারল্য ও ডলার সংকট, আর্থিক খাতের ভারসাম্যহীনতা, রিজার্ভ হ্রাস- এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেট করতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা আনতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, 'বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকায় বিশ্ববাজারে কমলে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া। এছাড়া পণ্যের সংকটের সুযোগ নিয়ে সীমিত আমদানিকারকরা সেসব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।' ডক্টর ফাহমিদা বলেন, গরুর মাংস, চিনি, সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। সবসময় যে বিশ্ববাজারকে দোষারোপ করবো সেটি নয়। কর কিছুটা কমিয়ে এনে স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে। বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। যে কোনো সংকটে হলে, তার সুযোগ নিয়ে বাজারে যে সীমিত পেস্নয়ার (আমদানিকারক) আছে, সীমিতসংখ্যক আমদানিকারক যারা এক একটি পণ্য আমদানি করে তারাই কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। বাজারের অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজার প্রক্রিয়া ক্রমশই দুর্বল হচ্ছে। বাজারে কোনো ধরনের মেকানিজম কাজ করছে না। বাজারের ভেতর ছোটদের প্রভাব ও অংশগ্রহণ ক্রমেই সীমিত হচ্ছে। বড়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়ছে। বাজেট প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এমন একটি সময়ে বাজেট প্রণীত হচ্ছে যখন বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ব্যাংক খাতের তারল্যে ব্যাপক নিম্নগামী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তারল্য ৬৬ হাজার ৫৮১ টাকা কমে গেছে। কারেন্সি সার্কুলেশন ব্যাংকগুলোর বাইরে বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সঞ্চয় করার প্রবণতাও কমছে। বাজারে অনিশ্চয়তা দেখছি। আর্থিক খাতে সুশাসনের কথা বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সেটা বলছে। তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম নিম্নমুখী হলেও স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। আমদানি ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে উলস্নম্ফন দেখতে পারছি না, এক ধরনের অবনমন দেখা যাচ্ছে। পোশাক খাতের রপ্তানি বাড়ছে, তবে পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি কমছে। নেট ফরেন এইড ১২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। যদিও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৪ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। ট্রেড ক্রেডিটে নেতিবাচক প্রভাব দেখছি।' দেশের অর্থনৈতিক দুঃসময়ের কারণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধকে আর অজুহাত করার সুযোগ নেই জানিয়ে ডক্টর ফাহমিদা বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধকে সবসময় একটা কারণ হিসেবে বলে এসেছি। সেটা আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়া কিংবা অর্থনীতির ওপর বিভিন্ন চাপের ক্ষেত্রে বলেছি। সেটা আর একমাত্র অজুহাত বললে হবে না। অর্থনীতির ভেতরে যে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের ফলাফল কিছুটা থাকলেও বাকিটা দেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তার ওপরে নির্ভর করছে। কীভাবে সংকটময় সময় পার করেছে।' তিনি আরও বলেন, 'অভ্যন্তরীণ নীতিমালা, সুশাসন, প্রয়োজনীয় সংস্কার না করার কারণে যে দুর্লতা সৃষ্টি হয়েছে। সেটাই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের প্রতিঘাত এখন বড় বিবেচ্য বিষয়, কিন্তু মূল নিয়ামক নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে সেটা করতে গেলে সরকারকে বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের আগের বছর সেটা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আহরণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে। আমরা গত ডিসেম্বরে বলেছি এর পরিমাণটা ৬৪ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। চলতি ও আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ানো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।' মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখে আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো, পোশাক খাত বাদে অন্য রপ্তানি খাতে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া, সিগারেট-কোমল পানীয়তে কর বাড়ানো প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।