ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার আতঙ্কে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা
প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
এম সাইফুল
ফ্লোর প্রাইস বা দর কমার র্সবনিম্ন সীমা প্রত্যাহার করা হতে পারে- এমন আতঙ্কে রয়েছেন শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দর আকাশচুম্বী করার পর চক্রটি চায় আরও দরপতন হউক। কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের কারণে দর কমছে না। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওপর ফ্লোর প্রাইস তুলতে বিভিন্নভাবে চাপ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
তীব্র দরপতনে ২০২০ সালে ১৮ মার্চ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩ হাজার ৬০৩ দশমিক ৯৫ পয়েন্টে নেমে আসে। ২০১৩ এরপর সূচক সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে আসে। ওইদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন রোধে ফ্লোর প্রাইস চালুর উদ্যোগ নেয় তৎকালীন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেন কমিশন। আর ১৯ মার্চ থেকে ফ্লোর প্রাইসের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়। তবে ফ্লোর প্রাইস চালুর পর থেকেই অনেক স্টেকহোল্ডার এটা নিয়ে বিরোধিতা করেন। তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেওয়ার জন্য বিএসইসির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি সুরক্ষায় সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের এই রেওয়াজ ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই শুরু হয়। করোনা মহামারি সংকট মোকাবিলায় ডিএসই লেনদেন বন্ধ করে দিতে
বাধ্য হন তৎকালীন কমিশন। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও ডিএসইর মান্ধাতার আমলের দুর্বল ট্রেডিং সিস্টেম আলোচনায় উঠে আসে। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, অনিয়মে ডুবে থাকা এই স্টক এক্সচেঞ্জের গঠনমূলক কোনো পরিবর্তন না হওয়ার করুণ চিত্র অবাক করে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীসহ দেশের সচেতন নাগরিকদের। পাশাপাশি আস্থাহীন এই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষার্থে কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই নিতে হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত। মহামারি সংকট ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করলে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশনের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশের প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল পুঁজিবাজারে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে পুঁজিবাজার, ফ্লোর প্রাইস নিষ্প্র্রয়োজন হয়ে পরে। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়। টানা পতন রোধে আবারও ফ্লোর প্রাইস আরোপ করতে বাধ্য হয় বর্তমান কমিশন।
অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইস বিষয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা থাকলেও এর পক্ষেই যুক্তি বেশি। তবে এভাবে ফ্লোর দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাতেই সমাধান মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এখান থেকে উত্তোলনের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে যেমন- ফ্লোর প্রাইসের আটকে থাকা কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো, বিএসইসির নেতৃত্বে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের উদ্যোগ গ্রহণ এবং গুজবে কান দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি না করলে অচিরেই কোম্পানিগুলোর শেয়ার ফ্লোর প্রাইস থেকে বেড়িয়ে আসবে। বন্ডের এক্সপোজার লিমিটের বিষয়টিকেও গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব পুঁজিবাজারের সঙ্গে মিল-অমিল : এদিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন দেখা যায়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সূত্র মতে, আমেরিকার ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে পতনের এক মাস আগে প্রায় ১২ মিলিয়ন টাকার শেয়ার বিক্রির অভিযোগ উঠে। দরপতন রোধে ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের লেনদেন স্থগিত করা হয়। অর্থনৈতিক মানদন্ড আমাদের দেশের থেকে শক্তিশালী হওয়াতে দ্রম্নত পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন তারা। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে জেপি মরগ্যান, মরগ্যান স্টেনলির মতো বিশ্বসেরা ফান্ড ম্যানেজাররা এগিয়ে এসেছেন। দ্রম্নত প্রদক্ষেপ নিয়ে সম্পদশালী ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করছেন। যেহেতু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল অর্থনীতির একটি দেশ, তবে উন্নত বলার সময় এখনো আসেনি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। পাশাপাশি বিদু্যৎ উদপাদন বৃদ্ধিতে জোরাল ভূমিকা রাখছে সরকার। ধীরে ধীরে মূল অর্থনীতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও বৈশ্বিক সংকটের চাপে অর্থনীতিতে এর সুফল সম্পূর্ণরূপে এখনো প্রতিফলন হচ্ছে না। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক মিল-অমিল প্রতিটি দেশেই আছে। তাই সব মিলিয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্তগুলো ভেবে নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : এদিকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক যায়যায়দিনকে বলেন, বাজারের সূচক যৌক্তিক পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস রাখতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগকারীরা ফোর্সড সেলে পরে যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন যায়যায়দিনকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস এখানে কোনো বিষয় নয়। যারা শেয়ারবাজারে ৪০ টাকার শেয়ার ৩১৫ টাকা নিতে পারে বা ১০ টাকার শেয়ার এক হাজার টাকায় নিতে পারে, তারা সক্রিয় হলেই বাজারে গতিশিলতা ফিরে আসবে। বর্তমানে যেখানে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া আছে সেটাকে অনেকেই যৌক্তিক দর মনে করছে না। তাই এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন, তারা ফোর্সড সেলের শিকার হবেন।