বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত পাকিস্তানিদের

প্রকাশ | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক পৃথক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে ব্রিটিশরা ভারতবষর্ থেকে বিতাড়িত হন। ভারত বিভক্তির সাথে সাথে পূবার্ঞ্চলের বেশিরভাগ বিত্তবান শিক্ষিত হিন্দুরা চলে যান পশ্চিমবঙ্গে আর অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান যারা শিক্ষিত ও নগরকেন্দ্রিক হয়ে উঠল, তারা যেন রাতারাতি আরব সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধমের্র আবেগে পাকিস্তানি ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ফলে সংস্কৃতির অঙ্গনে দেখা দিল শূন্যতা। তবে বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তান প্রেমের আচ্ছন্নতা কেটে যেতে বেশি সময় লাগেনি। পাকিস্তান কায়েমের এক বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি নিষ্পত্তি না করেই এনভেলাপ, পোস্টকাডর্, ডাকটিকিট, মানি অডার্র, ট্রেন টিকিট ও টাকার ওপর উদুর্ এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতিতে আঘাত শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের পটিয়ার কৃতীসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাথর্ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম (১৯২০-১৯৯১) পাকিস্তান সৃষ্টির ১৭ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠন করেন ‘তমদ্দুন মজলিস’। অনেকটা ইসলামী তমদ্দুনকে সমুন্নত করার প্রত্যয়ে এ সংগঠন গঠিত হলেও এ সংগঠনই প্রথম বাংলা ভাষার দাবিতে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। এর ধারাবাহিকতায় ওই সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না ঊদুর্’ শিরোনামে পুস্তিকা। এই পুস্তিকায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ‘আমাদের প্রস্তাব’, ড. কাজী মোতাহের হোসেন ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূবর্ পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ এবং আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৭-১৯৭৯) ‘বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে’ নামক তিনটি প্রবন্ধ লিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পাকিস্তান আমলে প্রথম আন্দোলন সংগঠিত করেন। এ পুস্তিকায় ‘আমাদের প্রস্তাব’ প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পাশাপাশি তমদ্দুন মজলিস কতৃর্ক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূবর্ বাংলার স্বায়ত্বশাসন অন্যথায় স্বাধীনতার দাবি তোলা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর বিকালে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (ঢাকা কলেজ) ছাত্রাবাস নূপুর ভিলায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উদুর্ করা হোক’ শীষর্ক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না ঊদুর্’ শিরোনামের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং ঘোষণাপত্র মতে কমর্পন্থা নিধার্রণের জন্য উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ঐকমত্য হয়। এ সেমিনারে অংশ নেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খঁা (১৮৯৪-১৯৭৮), কবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), অধ্যাপক কাজী আকরাম হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হক, শাহেদ আলী (১৯২৫-২০০২), সানাউল্লাহ নূরী (১৯২৮-২০০১)। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য এ পুস্তিকা জনমনে রেখাপাত করে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি করে। এ অবস্থায় তমদ্দুন মজলিস মাওলানা আকরাম খঁা (১৮৭০-১৯৬৮), মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ এসেম্বলি), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), আবুল কালাম শামসুদ্দিন (১৮৯৭-১৯৭৮), শামসুন নাহার মাহমুদসহ (১৮৮৮-১৯৬৪) হাজারো মানুষের দস্তখত সংগ্রহ করে তা স্মারকলিপি আকারে ১৯৪৭ সালের ১৪ নভেম্বর পূবর্ বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনকে প্রদান করে। কিন্তু এতেও শাসক দলের টনক না নড়ায় শিক্ষাথীর্রা বিক্ষুব্ধ হয়ে সভা-সমাবেশের আয়োজনে নামে। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে প্রথম জনসভা হয়। তমদ্দুন মজলিসের কণর্ধার অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (বতর্মানে ছাত্র সংসদ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমদ (১৯২৩-১৯৭১; পরবতীের্ত মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরিচিত এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ঘৃণিত হন ও নিহত হন), অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১; শহীদ বুদ্ধিজীবী), আবদুর রহমান চৌধুরী (১৯২৬-১৯৯৪; পরবতীের্ত বিচারপতি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এ কে এম আহসান (পরে সিএসপি/সচিব), কল্যাণ দাশগুপ্ত, এস. আহমদ প্রমুখ।